- পরিবেশকদেরও দাম বেঁধে দেয়ার দাবি
- ২৪৪ টাকা কমলেও বাজার অনিয়ন্ত্রিত
- বিইআরসি-পরিবেশক-গ্রাহক বিতণ্ডা থামছে না
- সরকার ঘোষিত দাম কেবল কাগজ-কলমে
খুচরা পর্যায়ে নির্ধারিত দাম বাস্তবায়নে বিইআরসি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে
—এম শামসুল আলম
জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব
ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির বাজার তদারকি করা হবে
—নূরুল আমিন
চেয়ারম্যান, বিইআরসি
গণশুনানির মাধ্যমে বিইআরসির এলপিজির দাম নির্ধারণ করতে হবে
—সেলিম খান
সভাপতি, এলপিজি ব্যবসায়ী সমিতি
তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) বাজার অনিয়ন্ত্রিত। আগে থেকেই চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। এলপিজি আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে ভোক্তা পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে থাকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। যার ফলে প্রতি মাসেই এলপিজি গ্যাসের দাম ওঠানামা করে। বিইআরসি এলপি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করলে গ্রাহক পর্যায়ে ত্বরিত কার্যকর হতে দেখা যায়। তবে দাম কমলে ভোক্তা পর্যায়ে তা আর কার্যকর হয় না। চলতি মাসের ২ এপ্রিল তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৪৪ টাকা কমিয়ে এক হাজার ১৭৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে এর দাম ছিল এক হাজার ৪২২ টাকা। এক লাফে ২৪৪ টাকা কমলেও ভোক্তারা এ সুফল এখনও পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছে, বিইআরসি ভোক্তা পর্যায়ে যে দাম নির্ধারণ করেছে সে দামে আমরা কিনতেও পারি না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ বাজার তদারকির অভাবে এলপিজির দামে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। বিইআরসি বাজার মনিটরিং করছে না। তাদের উদাসীনতায় এলপিজির বাজারে চলছে তেলেসমাতি। ফলে ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের কাছ থেকে খেয়ালখুশি মতো দাম নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আমার সংবাদকে জানান, এলপিজির দাম নির্ধারণে একক এখতিয়ার বিইআরসির। আর এই মূলাহার বাস্তবায়ন করাও বিইআরসির একক এখতিয়ার। তবে বিইআরসি দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারা বলছেন, এলপিজির বাজার তদারকির মাধ্যমে সমন্বয় সাধন করা দরকার। তাহলে বর্ধিত দামের পরও সিন্ডিকেটের বাড়তি বোঝা থেকে মুক্তি পাবে সাধারণ গ্রাহক। এদিকে বাজারে স্বেচ্চাচারিতার অভিযোগের কারণে ভোক্তাদের পাশাপাশি ডিস্ট্রিবিউটর বা পরিবেশকদের জন্যও এলপিজির দাম বেঁধে দেয়ার দাবি উঠেছে। এলপিজির মূল্য নির্ধারণে ডাকা সম্প্রতি বিইআরসির সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায় এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি। ওই সংবাদ সম্মেলনে মাঠ পর্যায়ে এলপিজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিইআরসি যে দাম নির্ধারণকরে দেয় অপারেটররা ফ্যাক্টরিতে তার চেয়ে বেশি দামে এলপিজি বিক্রি করেন। ফলে বিইআরসি-ব্যবসায়ী-গ্রাহক বিতণ্ডা চলছেই। যেন সুরাহা করার কেউ নেই।
ভোক্তারা বলছেন, এলপিজি সিলিন্ডারের সরকার ঘোষিত দাম কেবল কাগজ-কলমে। সরকার নির্ধারিত দামে আমরা কিনতে পারছি না। বাজারে খবর নিয়ে দেখা যায়, দাম কমার আগে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ছিল এক হাজার ৪২২ টাকা। চলতি মাসের শুরুতে ২৪৪ টাকা কমার পরও প্রভাব নেই বাজারে। খুচরা পর্যায়ে বিতরণ কোম্পানি ভেদে দাম হাঁকা হচ্ছিল এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা। নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি করছে না খুচরা বিক্রেতারা। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৩৫০ টাকায়। রাজধানীর মালিবাগ এলাকার এলপিজির খুচরা বিক্রেতা রাশেদ ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম চাইছিলেন এক হাজার ৩০০ টাকা।
বাড়তি দাম চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোম্পানি চাহিদা অনুযায়ী এলপিজি সরবরাহ করছে না। এমকি আমরা সরকার নির্ধারিত দামে কিনতেও পারি না। সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নতুন মূল্য নির্ধারণের পর ১২ কেজি এলপিজি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩০০ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, ডিলার পয়েন্ট থেকে তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ফলে সরকারের নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। যাত্রবাড়ীর মাক্কা ট্রেডার্সের মালিক কামরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, আমার ১২ কেজি সিলিন্ডার কেনায় এক হাজার ২০০ টাকার ওপরে খরচ পড়ছে। আমার পক্ষে সরকার নির্ধারিত এক হাজার ১৭৮ টাকায় বিক্রি সম্ভব নয়। অন্যথায় ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।
মনিকনগরের এলপিজি ব্যবসায়ী সায়েম খান আমার সংবাদকে বলেন, বিইআরসি গ্যাসের দাম কমিয়েছে এটি ভালো খবর। কিন্তু আমরা তো এই দামে কিনতে পারছি না। ফলে আমাদেরকে সরকার বিতর্কের মুখে ছেড়ে দিয়েছে। রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশে নির্মিত নতুন আবাসিক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ নেই। ফলে তারা সিলিন্ডারে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া রাজধানীর বাসাবাড়িতে গ্যাসের স্বল্পতায় অনেকেই এলপিজি ব্যবহার করছেন। এতে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী এলপিজির কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। এমনটাই মনে করছেন অনেক খুচরা ব্যবসায়ী। এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ আবু তাহের বলেন, আমি ১০ লাখ টাকার গ্যাস কিনেছি। লোয়াব এক হাজার ২০০ টাকা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর সঙ্গে ডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর এবং বিক্রয়কারীদের লাভ ও পরিবহন ব্যয় রয়েছে। আমরা যদি এক হাজার ২০০ টাকায় কিনে এই অঙ্কগুলো যোগ করি তাহলে এলপিজির ১২ কেজির সিলিন্ডার কত করে বিক্রি করব। এলপিজি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি সেলিম খান আমার সংবাদকে বলেন, বিইআরসি নির্ধারিত দামে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সরবরাহ কোম্পানি ভেদে আমাদেরকে ১২ কেজি সিলিন্ডার এক হাজার ২০০ টাকা, সাড়ে এক হাজার ২০০ টাকা দরে কিনতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে বিইআরসিকে জানিয়েছি গ্যাস সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে গণশুনানির মাধ্যমে যেন দাম নির্ধারণ করে।
তিনি আরও যুক্ত করে আমার সংবাদকে বলেন, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুচরা পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। ইতোমধ্যে আমার কাছে মামলার কিছু কাগজও এসেছে। এলপিজির দাম নিয়ে বাজারে সমন্বয়হীনতার বিষয়ে বিইআরসি চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে কি-না সে বিষয়ে তদারকি করা হবে। আমরা নিজেরাই এলপিজির বাজার মনিটর করতে মাঠে নামবো। এর বাইরেও জেলা প্রশাসক এবং ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আলাদা করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, এলপিজির দাম নির্ধারণের একক ইখতিয়ার রয়েছে বিইআরসির। আর এই নির্ধারিত মূলাহার বাস্তবায়ন করাও বিইআরসির কাজ। বিইআরসি সে দায়িত্ব কখনো পালন করেনি। গ্রাহকরা নির্ধারিত মূল্যে গ্যাস পাচ্ছে কি-না তা সঠিক বাস্তবায়নে বিইআরসি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।