বহাল তবিয়তে এনবিআরের সেই পিয়ন

নুর মোহাম্মদ মিঠু প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৩, ০২:১৩ এএম
বহাল তবিয়তে এনবিআরের সেই পিয়ন
  • ছয় মাস হাজতবাস, চার্জশিটের পরও নীরব এনবিআর
  •  হাজতে বসেই পেয়েছেন বেতন-ভাতা
  •  বর্তমানে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে
  •  শফিকুলের দাবি —নিষ্পত্তি হয়ে গেছে
  •  বোনের ভবিষ্যৎ চিন্তায় আপসে বাদীর সম্মতি

 

চার্জশিটের পরই সাসপেন্ড হওয়ার কথা, সাসপেন্ড অবস্থায় ভাতার অর্ধেক পাবেন

—আবদুল আউয়াল মজুমদার

সাবেক সচিব

 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের আশকারায় অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের পাহাড় গড়েছেন কর অঞ্চল-৪, সার্কেল-৮৮ এর পিয়ন (নোটিস সার্ভার) শফিকুল ইসলাম। দুর্নীতি দমন কমিশনে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একটি অভিযোগ সূত্রে এসব সম্পদের তথ্য প্রকাশ্যে এলেও রহস্যজনক কারণে নীরব এনবিআর। শুধু কি তাই; ফৌজদারি (ধর্ষণ মামলা) অপরাধে জড়িয়েও এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। উল্টো ধর্ষণ মামলায় ছয় মাস হাজতবাস থাকা অবস্থায়ও নিয়মিত পেয়েছেন বেতন-ভাতা। হাজতবাস শেষেও শফিকুলকে দিতে হয়নি অফিসে অনুপস্থিত থাকার কোনো জবাবও। যেখানে ফৌজদারি অপরাধে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাজতবাসের জন্যও সাসপেন্ড করার বিধান রয়েছে। শুধু হাজতবাসই নয়, ধর্ষণেরওই মামলায় শফিকুলের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দিয়েছে পুলিশ। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনবিআরের অদৃশ্য খুঁটির জোরেই অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন শফিকুল। তিনি যেন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। জানতে চেয়ে গত সোমবার কর অঞ্চল-৪ এর সেগুনবাগিচা কার্যালয়ে সরাসরি গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শফিকুলের অনিয়মের বিষয়ে কথা বলা কিংবা দেখা করতেও রাজি হননি। তবে ওই কর্মকর্তা উপ-কমিশনার সদর দপ্তর (প্রশাসন) দেখা না দিলেও তার স্টাফদের মাধ্যমে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। অথচ এ বিষয়ে সাবেক আমলারা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের কোনো মামলায় চার্জশিট হলেই সাসপেন্ড হওয়ার কথা। সেখানে রহস্যজনক কারণে শফিকুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে নির্লিপ্ত এনবিআর।

সূত্র জানায়, পিয়ন শফিকুলের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি এখন এনবিআরে অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। আর এসবের প্রশ্রয়দাতাও খোদ এনবিআরের একাধিক অসাধু কর্মকর্তা, যাদের সঙ্গে শফিকুলের রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগসাজশ। তাদের ক্ষমতার বলে বলীয়ান শফিকুল। যে কারণে সব অনিয়মই তার কাছে নিয়ম। এনবিআরের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়া তার কাছে মামুলি বিষয়। আর দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বিঘ্নে সম্পদ গড়তে পল্টনের রিসোস ফুল সিটিতে করেছেন প্রাইভেট চেম্বার। এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরকারি গাড়িতে চলাফেরা করলেও শফিকুল চড়েন নিজস্ব বিলাসবহুল নিশান এক্সট্রায়াল গাড়িতে। 

চাঁদপুরে গড়েছেন তিনতলা বিশিষ্ট বিশালাকার গরুর খামার, পদ্মাপাড়ের সেই খামারের আশপাশে কিনেছেন একর একর সম্পত্তি, কেরানীগঞ্জে দোকান, নারায়ণগঞ্জে জমি। নামে-বেনামে আরও অসংখ্য সম্পদের মালিক তিনি। যার সবই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বলে জানা যায় দুর্নীতি দমন কমিশনে তার বিরুদ্ধে হওয়া অভিযোগ সূত্রে। যেখানে এনবিআরে চাকরির আগে শফিকুল ছিলেন জেলে পরিবারের সন্তান। তিনি নিজেও অকপটে স্বীকার করেন তা। ওপেন সিক্রেট এসব বিষয় এনবিআর যেন দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না, জেনেও জানে না। এর আগে আমার সংবাদে শফিকুলের সম্পদের ফিরিস্তি উল্লেখ করে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের পরও যখন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি এনবিআর, তখন বিশদ অনুসন্ধানে জানা যায়, কথায় কথায় আলহাজ পরিচয় দেয়া সেই পিয়ন শফিকুলের রয়েছে নারীলিপ্সাও।

২০১৯ সালের একেবারে শেষে দিকে ডাক্তার দেখাতে চাঁদপুর থেকে শফিকুলের ঢাকার সেগুনবাগিচার বাসায় আসেন তার স্ত্রীর খালাতো বোন। যাকে তিনি ধর্ষণ করে অলিখিত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। খালাতো শ্যালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে শাহবাগ থানায় তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালে মামলাও করেন তার ভাই আরিফ হোসেন। শাহবাগ থানার মামলা নং-৩৩। ওই মামলায় ২০২০ সালের শেষ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেয় শাহবাগ থানা পুলিশ, যার নম্বর-২৬৯। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল-৮-এ বিচারাধীন; যার নম্বর-২৯৮/২০। আগামী ৩ মে শুনানির দিনও ধার্য রয়েছে। এরই মধ্যে ধুরন্ধর পিয়ন আলহাজ শফিকুল সব তথ্য প্রমাণ নিজের বিরুদ্ধে যাওয়ায় মামলার রায়ের আগেই বাদীপক্ষের সঙ্গে আপসের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ওই মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। 

বাদীপক্ষ এখন কেন আপসের কথা বলছে তা তো বলতে পারি না। তবে মামলার বাদী আরিফ হোসেন আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, শফিকুলের কাছ থেকে আপসের প্রস্তাব পেয়েছেন তারা। বাদী তার বোনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সেই প্রস্তাবে সম্মতিও দিয়েছেন। এ ছাড়া শফিকুল সম্পর্কে তার খালাতো বোনের স্বামী। সেই বোনের সংসার, ভাগিনা-ভাগ্নির ভবিষ্যৎ চিন্তা করেও তিনি আপস প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন। যদিও তিনি বলছেন, চাইলে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করেই তিনি আপসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এদিকে শফিকুলের কথার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিষ্পত্তি কিংবা আপস কোনোটিই হয়নি এখনো; বরং বর্তমানে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। তবে এনবিআরের একাধিক সূত্র বলছে, মামলা রায়ের আগেই বাদীকে আপস প্রস্তাব দেয়া শফিকুলের একটি বিশেষ ফন্দি। মামলা থেকে বাঁচতেই এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে শফিকুল আপসের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ ফৌজদারি অপরাধে জড়ালে চাকরিবিধি অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নিতে পারতো এনবিআর— এমন প্রশ্নে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কথা না বললেও সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, মামলার পর হাজতবাস করলেও সাসপেন্ড হয়ে যাবে। আবার কোনো মামলায় চার্জশিট হলেও সাসপেন্ড করতে হবে। তবে এ নিয়ে হাইকোর্টের রুলও আছে (অবজারভেশন), নির্দেশ নয়। সেখানে বলা হয়েছে— চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত তাকে বহাল রাখতে হবে। তবে এটি মানাও বাধ্যতামূলক নয়। তিনি বলেন, সাসপেন্ড হওয়ার পর সেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অর্ধেক বেতন পাবে। সাসপন্ডে বহাল থাকা অবস্থায় পুরো বেতন পাবেন না।