সবাই একসাথে পুরো মাসের বাজার করছে, তাই পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এমন অজুহাত ছিল রমজানের আগে। তাহলে তো এখন দাম কমে যাওয়ার কথা। কারণ যারা পুরো মাসের বাজার করেছে তারা তো এখন আর বাজারে আসছে না। এখন বাজারে এত ভিড় কেন। পুরো মাসের বাজার কারা করল। দাম তো একই আছে। বাস্তবতা হলো— ব্যবসায়ীদের অজুহাতের শেষ নেই। কখন যে কি বলে তা নিজেরাও জানে না। তাদের দরকার টাকা। মানুষ মরে যাক, তাতে কিছু আসে যায় না। গতকাল কমলাপুর বাজারে এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন শিক্ষার্থী রেজাউল।
বিক্রেতা সাজু মিয়া বলেন, আমাদের বলে লাভ নেই— পাইকাররা যা বলে দাম বাড়ায় আমরাও ক্রেতাদের তাই বলি। আমরাতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দাম কমানো বা বাড়ানোতে আমাদের কোনো হাত থাকে না। অথচ ক্রেতাদের মুখোমুখি আমাদেরই হতে হয়। আমাদের দুঃখ কেউ বুঝে না। ক্রেতারা গালি দেয়, তর্ক করে; ব্যবসার খাতিরে সব মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। কিছু পণ্যের দাম স্থিতিশীল আছে।
কিন্তু এটি বর্ধিত দাম। অর্থাৎ রোজার উপলক্ষে বেড়েছিল আর কমেনি। আবার কিছু পণ্যের দাম আরও বেড়েছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সর্বনিম্ন ৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে সবজি। এর কমে কিনতে গেলে মান ঠিক থাকে না। অর্থাৎ ত্রুটিযুক্ত পণ্য কিছুটা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতিদিনই ওঠানামা করছে, কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারভেদে গরুর গোশত ৭৫০ থেকে ৭৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগির ডিমের হালি ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। আর দেশি মুরগির ডিমের হালি ৮০ টাকা, হাসের ডিম ৬০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর ও কাপ্তানবাজারে খবর নিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এক প্রশ্নের উত্তরে ক্রেতা মাজেদুল এ প্রতিবেদককে বলেন, একটা লাউ ১০০ টাকা, এরপর বাজারের চিত্র আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।
সব ধরনের মাছের দাম প্রায় অপরিবর্তিত আছে। কোনোটা কিছু কমেছে তো আবার কোনোটা বেড়েছে। কাপ্তানবাজারের মাছ বিক্রেতা শহিদুল বলেন, দাম কমেনি তবে স্থির আছে। কমলাপুল বাজারের বিক্রেতা রনি জানান, কিছু জিনিসের দাম বেড়েছে। বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার আমার সংবাদকে বলেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি করা হচ্ছে। অধিদপ্তরের টিম সার্বিকভাবে অভিযান পরিচালনা করছে। তিনি জানান, রমজানের শুরুতে নিত্যপণ্যের বাজার যেভাবে অস্থিতিশীল হয়েছিল, তার তুলনায় এখন কিছুটা স্থিতিশীল। ইফতারির বাজারের একই চিত্র। ক্রেতা বেশি বিক্রি নেই।
আশা নিয়ে বাজারে আসেন দাম শুনে কিনেন না অথবা কম কিনেন ক্রোতারা। বেসরকারি চাকরিজীবী রিপন বলেন, প্রতি বছর রমজানে বিভিন্ন ইফতারির বাজারে ঘুরে ঘুরে ইফতার কিনি। এটি আমার শখ। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এমনিতেই অন্যান্য জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় পকেটের অবস্থা খারাপ। তার মধ্যে ইফতারির দামও বাড়তি। এখন শখ মেটানোর সময় সুযোগ নেই। প্রয়োজন মেটাতে পারলেই খুশি।
বিক্রেতারাও বললেন একই কথা। বাজারে ভিড় আছে কিন্তু বেচাকেনার অবস্থা খারাপ। প্রতি রমজানেই বিক্রির একটি টার্গেট থাকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি নাজুক। খরচাপাতি দিয়ে চালান ধরে রাখতে পারলেই খুশি। চক বাজারের ইফতার বিক্রেতা মারুফ বলেন, লাভ ভালোই হচ্ছে কিন্তু বিক্রি কম। বেচাকেনা এত কম হলে মাস শেষে টার্গেট পূরণ তো দূরে থাক ঈদটা ভালোভাবে করতে পারব কি-না তা নিয়েই চিন্তায় আছি। অন্যদিকে দিন যত গড়াচ্ছে ঈদ ততই কাছে আসছে। ঈদ মানে খুশি হলেও খুশি নেই গৃহকর্তার মনে। কারণ সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই হিমশিম অবস্থা, ঈদের বাজার কিভাবে করবেন। অনেকেই ধারদেনা করছেন আবার অনেকে কাটছাঁট করার পরিকল্পনা করছেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী প্রকাশ কায়েফ আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমার বিয়ের পর এটিই প্রথম ঈদ।
অনেক আশা ছিল বাবা-মা, ভাইবোন, শাশুরি ও শ্যালিকাদের উপহার কিনে দেবো। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, বোনাস দূরে থাক, ঈদের আগে বেতনটা পাব কি-না তা নিয়েই সন্দেহ। জীবনযাত্রার ব্যয় এত বেড়েছে যে, জমানো সব টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন নিয়মিত খরচ মেটানোই কঠিন।’ বিক্রেতারাও আছেন হতাশায়। নিউমার্কেটের বিক্রেতা মোশারেফ জানান, প্রতিটি পোশাকের দাম ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। বাড়তি দাম শুনেই ক্রেতারা চলে যাচ্ছেন। কেউ তিনটির পরিবর্তে একটি কিনছেন।
প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, মানুষ খাবার কিনতে পারে না; আবার পোশাক কিনবে কিভাবে। আমরা আছি মহা সমস্যায়, করোনা গেল; এখন আবার ডলার সংকটসহ নানা কারণে দাম বাড়তি। বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনার পর দাম আরেক দফা বেড়েছে। এমন অবস্থায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন। বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে আগুন জ্বলছে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির জন্য বাজার সিন্ডিকেট দায়ী, সরকারের দুর্নীতি দায়ী। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির পেছনে কিছু বাস্তবতা আছে এটি ঠিক কিন্তু কিছু ব্যবসায়ীর অনৈতিক আচরণের কারণে পণ্যমূল্য সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। শক্তিশালী বাজার তদারকির মাধ্যমে এটি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’