- বিএমইটির চরম অনীহা, দালাল কর্মকর্তা যেন একই সূত্রে গাঁথা!
- বিএমইটিতে দালালের খপ্পরে অতিষ্ঠ মানুষ, ১৫-২০ টাকা দিলেই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সেবা মিলছে
ব্যক্তি উদ্যোগে কাজগুলোর ঝুঁকি থাকে ব্যক্তি কার কাছে যাবে ধর্ণা দেবে তাই এজেন্সির মাধ্যমে করা হচ্ছে
—মো. শহীদুল আলম, মহাপরিচালক, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো
বিদেশ গমনেচ্ছুদের ভোগান্তি কমাতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে গত বছরের শেষের দিকে অনলাইনে বিএমইটি ক্লিয়ারেন্সসহ নাগরিক সম্পৃক্ত চারটি পরিষেবাকে ডিজিটাইলেশনের আওতায় আনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটি। এই সেবাগুলোর মধ্যে বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেইনিং কোর্স ও সার্টিফিকেট, পিডিও সেশন বুকিং এবং বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স অন্যতম। যার মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার সব কার্যক্রম ঘরে বসেই সারতে পারবেন যে কেউ।
তবে, ডিজিটালাইজেশনের পর থেকেই বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেইনিং কোর্স ও সার্টিফিকেট, পিডিও সেশন বুকিংসহ এই তিনটি ডিজিটাল সার্ভিস বিদেশ গমনেচ্ছুদের মনোযোগ বাড়ালেও চরম অনীহা ডিজিটাল বিএমইটি ক্লিয়ারেন্সের প্রতি। অর্থাৎ প্রতিদিন যত পরিমাণ বিএমইটি রেজিস্ট্রেশনের আবেদন, তার প্রায় শতভাগই সম্পন্ন হয়ে থাকে অনলাইন ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার করে, ঘরে বসেই। একই অবস্থা পিডিও এবং ট্রেইনিং কোর্সের ক্ষেত্রেও।
আগে একজন বিদেশগামী কর্মীকে সরাসরি এসে বিএমইটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে তার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হতো। আর কোনো ট্রেইনিং সেশনের জন্যও টিটিসিগুলোতে যেতে হতো সরাসরি। বেশির ভাগ সময়েই কয়েক দফা যেতে হতো ট্রেইনিং কোর্সের ভর্তি এবং সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য। একইভাবে প্রিডিপার্চার ওরিয়েন্টেশনের (পিডিও) সেশন বুকিংয়ের জন্য দুর্ভোগে পড়তে হতো বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের। আর এখন এ সকল পরিষেবা ডিজিটাল হওয়ায় দুর্ভোগ আর ভোগান্তির মাত্রা শূন্যের কোটায় এসেছে। সেই সাথে কমেছে অর্থের অপচয়ও। তবে, নামে ডিজিটাল হলেও এখনো আগের মতোই রয়েছে ভোগান্তির আরেক নাম বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স।
যদিও গত বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে পুরোপুরি ডিজিটাইলেশনের আওতায় আনা হয়েছে এই পরিষেবাকে। তারপরও কোনো এক অদৃশ্য কারণে বিএমইটির ডিজিটাল ক্লিয়ারেন্সের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মী। এখনো আগের মতোই লাইনে দাঁড়িয়ে বা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই নিতে হচ্ছে বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স।
মঙ্গলবার সকালে কমলাপুর থেকে ইকবাল হোসেন নামে একজন বিএমইটিতে এসেছেন স্মার্ট কার্ড নিতে। তখনই ইকবালের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তার মামা সৌদি আরব থেকে একটি ভিসা পাঠিয়েছিলেন। আর এ জন্য তিনি নিজেই অনলাইনে সারেন বিদেশ যাওয়ার সব কার্যক্রম, শেষে এসে শুধু বাধ সাধে বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স। অনলাইনে আবেদন করায় অনেক বিলম্ব হচ্ছিল তার বিএমইটি ক্লিয়ারেন্সের বিষয়টি, আর অন্যদিকে তার ভিসার মেয়াদও ফুরিয়ে আসায় মামা অন্য যেকোনো উপায়ে তাড়াতাড়ি তার ম্যানপাওয়ারের কাজটি করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন।
অবশেষে নিজেই বহির্গমন ছাড়পত্র পেতে ছুটে আসেন বিএমইটিতে। এসেই পড়তে হয় এক দালালের খপ্পরে, তিনি নিয়ে যান আল সৌরভ রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে। সেখানে জানানো হয়, কর্মকর্তারা টাকা না পেলে কোনোভাবেই ক্লিয়ারেন্স দেন না। এ জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে ক্লিয়ারেন্সের আবেদন করে কোনো লাভ নেই। অবশেষে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে এক দিনের ম্যধেই তার স্মার্ট কার্ড হাতে পেয়েছেন ইকবাল। এর পরপরই আক্ষেপের সুরে এই প্রতিবদেককে ইকবাল জানান, ভাই সরকার যতই আমাগো ভোগান্তি কমাতে চায়, অফিসাররা ততই বাড়ায়, ট্যাকা না দিলে এইডার সুবিধা আমাগো কপালে নেই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএমইটির এক কর্মকর্তা বলেন, ভাই আমাদের মধ্যেই ঝামেলা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া তো সরকার শুরুই করেছে,আর আমরা আছি শুধু আমাদের ভাগ নিয়ে। এখনে কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই অনলাইনে ক্লিয়ারেন্সের ঝামেলা বাধায় যেন মানুষ এটি অনলাইন থেইকা না নেয়।’ এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিএমইটি ক্লিয়ারেন্সের জন্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বা কোনো কোনো সময় আরো বেশি টাকা নেই। আর এ জন্য নন এটাস্টেডে আর এটাস্টেড স্মার্ট কার্ডের যে সামান্য সরকারি ফি আসে এটি দিয়ে অনেক টাকা নিজের পকেটে রাখতে পারে।
এই কাজে কর্মকর্তারাই এজেন্সিগুলোর সহায়ক হিসেবে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। বলেন, আপনি নিজে শুধু আপনার ফাইলটা নিয়ে যাবেন, তারা বলবে কোনো এজিন্সির মাধ্যমে যেতে। কারণ তারা এজেন্সির কাছে থেকে প্রত্যেক বইয়ের জন্য টাকা নেয়। সরেজমিন গিয়েও এই চিত্রের সাথে মিল পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে বহির্গমণ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাই নিয়ম। আর বেশি কিছু জানতে চাইলে তিনি ব্যবস্ততার অজুহাতে আর কথা বলতে পারবেন না বলে জানান।
আসলে সমস্যাটা কোথায়? বিএমইটির ডিজিটাল সার্ভিস প্রোভাইডার আমি প্রবাসী লিমিটেডের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ডিজিটাল ক্লিয়ারেন্সের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি এবং বিএমইটি কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা আলাদা ইউজার আইডি দেয়া আছে। যা দিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাদের ডিজিটাল সেবাগুলো নিতে পারবেন আর কর্মকর্তাদের আইডি দিয়ে আনলাইনে যে ফাইলগুলো জমা পড়েছে সেগুলোর বাছাইপূর্বক তড়িত অনুমোদন করতে পারবেন। ডিজিটালি অনুমোদন শেষে একটি কিউআর কোডের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাদের নিজেরাই তাদের স্মার্ট কার্ড ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। সেটা বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বসে ডাউনলোড করতে পারবেন। সুতারাং এই প্রক্রিয়ায় সত্যিকার স্মার্ট কার্ড পাচ্ছেন বিদেশেগামী কর্মীরা। আর স্মার্ট অভিবাসনের মধ্য দিয়েই স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রা, সেটি এই অভিবাসনের হাত ধরেই।
তবে, বেশির ভোগ সেবাগ্রহিতারা ডিজিটাল এই প্রক্রিয়ায় ক্লিয়ারেন্স নিতে আগ্রহী নন। এ রকারণ হিসেবে তারা বলছেন, ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় ক্লিয়ারেন্সের জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয় এবং হয়রানির শিকার হতে হয়। আর আগের মতো করে এনালগে ফাইল নিয়ে গেলেই কর্মকর্তারা অনুমোদন করে দেয়। নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক এক রিক্রুটিং এজেন্সির কর্ণধার বলেন, আগে কর্মকর্তাদের ঠিক করেন, তারপর আমাদের সচেতন করুন। ‘আমরা অনলাইনে আমি প্রবাসীর মাধ্যমে ক্লিয়ারেন্সের জন্য সব ফাইল জমা দেই, কিন্তু সেটার আর কোনো আপডেট আমরা পাই না। অপেক্ষা করতে করতে আমরা বিরক্ত হয়ে গেছি।
অনলাইনের কোনো ফাইলের প্রতি কর্মকর্তাদের মনোযোগ নেই।তবে, আমরা ফাইল নিয়ে গেলেই সাথে সাথে কাজ হয়ে যায়,আমাদের কাজ করে তাদের লাভ হয়, আর ডিজিটালের কাজ করে তো আর তাদের পকেটে কিছু ঢোকে না।’ অনলাইন ভোগাগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো পরিচালক (প্রশাসন) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী কোনো মন্তব্যে করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের বড় কর্মকর্তা কথা বলেন। আপনি তাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক শহিদুল আলম এনডিসির আমার সংবাদকে বলেন, আসলে অভিযোগ কারা করে তো জানি না বিষয়গুলো আসলে দেখতে হবে। উনি কোন দেশে যাবে। এটি আসলে কি নরমাল প্রসেস কি-না। আর মূলত বিষয়গুলো রিক্রুটিং এজেন্সির পক্ষ থেকে করতে হবে। ব্যক্তি করার এখনো সুযোগ নেই। অনলাইনে করতে আমরা চেষ্টা করব ভবিষ্যতে, আশা করছি পূর্ণ সফল হবো। ব্যক্তি উদ্যোগে হয়তো ভবিষ্যতে উন্মুক্ত করতে পারব ।
তবে আসলে এক দিনে তো আর ৫০ বছরে রীতি নীতি বদলে ফেলা যায় না। আমাদের অবশ্য একটি জিনিস মাথায় রাখতে হয় ব্যক্তি উদ্যোগে যদি কাজগুলো হয়ে থাকে তাহলে ঝুঁকি থাকে। ব্যক্তি কার কাছে যাবে ধর্ণা দেবে। যদি কোনো ঝুঁকিতে পড়ে। কিন্তু এজেন্সির মাধ্যমে হলে বা কোনো খপ্পরে পড়লে এজেন্সি পুরো দায়ভারটা নেবে। আমি দৃঢ়তা সাথে বলতে পারি আমি দায়িত্বে আসার পর কাজের গতি তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে, ভোগান্তি অনেক কমে এসেছে। সমপ্রতি নন এটাস্টেড ভিসায় স্মার্ট কার্ড না দিতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠিও দেয়া হয়েছে বিএমইটিকে। সেখানে নন এটাস্টেড এবং সার্টিফিকে নেই এমন ফাইলের ছাড়পত্র না দিতে বিএমইটিকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
কিন্তু, মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রতিনিয়তই নন এটাস্টেড ভিসার ছাড়পত্র হচ্ছে এবং সার্টিফিকেট ছাড়াই পুরুষ এবং মহিলা সবাই দেয়া হচ্ছে বহির্গমন ছাড়পত্র। নিয়ম অনুযায়ি, বিদেশ গমনেচ্ছু যেকোন কর্মীকে বিদেশে গিয়ে কি কাজ করবেন এজন্য বিএমইটির আওতাধীন কোন টিটিসি থেকে স্কিল কোর্সের জন্য ন্যূনতম তিন মাসের একটি ট্রেইনিংয়ের সার্টিফিকেট থাকতে হয়। যেন বিদেশে গিয়ে কাজ করতে কোনো অনুবিধায় পড়ে দেশ ফিরতে না হয়। তাই সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো কর্মীকে ছাড়পত্র দেয়ার কোনো নিয়ম নেই। তবে, বিএমইটি এখন এসব নিয়মের কান ধার ধারছেইনা উল্টো পুরুষ কর্মীর পাশাপাশি নারী কর্মীদেরও সমানতালে সার্টিফিকেট ছাড়াই দেয়া হচ্ছে বহিগর্মণ ছাড়পত্র এমন অভিযোগও রয়েছে।