- বিশ্ব ফুটবল সংস্থার তদন্তে সোহাগের অনিয়ম আপিল করবেন সোহাগ
- সাফে ২০০৯ সালের পর গ্রুপপর্ব পেরোতে পারেনি বাংলাদেশ
- ২০১৭-২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফিফার দেয়া ফান্ডের অপপ্রয়োগ করেছে বাফুফে
বাংলাদেশের ফুটবলে হচ্ছেটা কী! তার কোনো ব্যাখ্যা হয়তো কারো কাছেই নেই। স্বয়ং বাফুফে সভাপতিও হয়তো এর কোনো ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। কদিন আগেই অলিম্পিক বাছাইপর্ব খেলতে মেয়েদের মিয়ানমার পাঠানোর নাম করে অর্থ নয়ছয় করার অভিযোগ উঠেছিল বাফুফের বিরুদ্ধে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে অর্থ চেয়েছিল বাফুফে; সেখানেও ছিল গলদ। এ নিয়ে তোলপাড় কম হয়নি। কদিন যেতে না যেতেই আরও একটি ঝড় বয়ে গেল ফুটবলপাড়ায়।
এবার ফিফার তদন্তে উঠে এসেছে আবু নাঈম সোহাগের অনিয়ম ও দুর্নীতি। আর্থিক জালিয়াতির কারণে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগকে গত শুক্রবার দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। পাশাপাশি জরিমানা করেছে প্রায় ১২ লাখ টাকা। ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফিফার দেয়া ফান্ডের অপপ্রয়োগ করেছে বাফুফে। সেই দোষেই নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে সোহাগকে।
বিশ্ব ফুটবল সংস্থার তদন্ত রিপোর্টে উঠে এসেছে বেশ কিছু অনিয়মের তথ্য। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১৩ হাজার ৯২১ ডলার দিয়ে ৪০০টি ফুটবল কেনে বাফুফে। যেখানে দরপত্র জমা দেয় তিনটি প্রতিষ্ঠান মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এইচ ইউ জামান ট্রেডিং ও ওফেলিয়াস ক্লোজেট। নিলাম শেষে ফুটবল সরবরাহের কাজটা ওফেলিয়াসকেই দেয়া হয়। তার অনুমোদন দেন সোহাগসহ পাঁচ কর্মকর্তা। এরপর ফেব্রুয়ারিতে সোহাগের নির্দেশে ওফেলিয়াস ক্লোজেটকে ফাইনাল পেমেন্ট করা হয়। সোহাগের স্বাক্ষরকৃত কাগজে লিখা ছিল, ফিফা অনুমোদিত বাফুফের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ২০১৯-২০ মৌসুমের ম্যাচ পরিচালনার জন্য এই কেনাকাটা প্রয়োজন।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ক্রীড়াপণ্য সরবরাহ করে থাকে। কন্ট্রোল রিস্কের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওফেলিয়াস ক্লোজেটের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটার কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা নারীদের পোশাক সেলাই করে। তাই ফুটবল বিক্রি করা তাদের পক্ষে অসম্ভবই বলা যায়। বাফুফেকে ফুটবল সরবরাহের প্রতিষ্ঠান নয় এটি। মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের দরপ্রস্তাবে তাদের খুঁজে পাওয়ার মতো তথ্য নেই। কোনো সিল নেই দরপ্রস্তাবে। তাদের অস্বিত্ব আছে কি-না সেই ব্যাপারেও কোনো মন্তব্য করতে পারেনি কন্ট্রোল রিস্ক।
বাংলাদেশ জাতীয় দল কমিটি ২০২০ সালের জুনে আবাসিক ক্যাম্প ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ম্যাচের জন্য কিছু ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। যার জন্য দরপত্র জমা দেয় স্পোর্টস লিংক, স্পোর্টস কর্নার ও রবিন এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। বাফুফে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৩০ হাজার ২৭ ডলারের মূল্যের পণ্য কেনার কার্যাদেশ দেন সোহাগ। বিডিংয়ে মালামাল সরবরাহের দায়িত্ব পায় স্পোর্টস লিংক। তবে যে তিনটি কোম্পোনি বিড করেছিল সেই তিনটি কোম্পানির একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপের তদন্তে উঠে আসে এমন তথ্য।
বিডিও এলএলপির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্পোর্টস কর্নার আর স্পোর্টস লিংক পাশাপাশি ঠিকানায় অবস্থিত। আবার স্পোর্টস লিংকের মালিক রবিনই সম্ভবত স্পোর্টস কর্নারের সাবেক মালিক। তাই গত সেপ্টেম্বরে বিশেষজ্ঞদের দেয়া এক রিপোর্টে লেখা হয় যে তিনটি দরপত্রের উৎসই এক; তিনটি আলাদা কোম্পানি নয়।
বিডিওর রিপোর্টে বলা হয়, ওফেলিয়াস এর ফুটবল সরবরাহের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাদের আমদানি সনদও নেই। তবে এক বন্ধুর সনদ ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন ওফেলিয়াস এর মালিক। ওফেলিয়াস ক্লোজেট থেকে কোনো চালান না পাওয়া সত্ত্বেও বাফুফে প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থ পরিশোধ করে। ফিফার মতে এটি স্পষ্ট যে সব কটি দরপ্রস্তাবই বানোয়াট ও অন্যকিছু লুকানোর উপাদান ছিল এতে। ফটোকপিতে মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের স্বাক্ষরিত দরপত্র দেয়া হয়েছে, মূল কাগজ নয়। কাতার বিশ্বকাপ প্রাক বাছাই পর্ব খেলার জন্য ওমান সফরে যায় বাংলাদেশ জাতীয় দল। সেই সফরে ফ্লাইটের টিকিট বাবদ আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ১৯ হাজার ৯২৫ ডলার দেয় বাফুফে।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য আরও দুটি প্রতিষ্ঠান পূরবী ইন্টারন্যাশনাল ও মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের দরপ্রস্তাব পান সোহাগ। অক্টোবরে আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে অর্থ প্রদানের অনুমোদন দেন তিনি। ফিফা ফরোয়ার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে দুটি চেক ইস্যু করা হয়। ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এক হাজার ৪১২ মার্কিন ডলারে ঘাস কাটার যন্ত্র কেনে বাফুফে। দুটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দেয়। ফিফার তদন্তে বলা হচ্ছে, সব দরপত্রই একই জায়গা থেকে করা হয়েছে।
এ ছাড়া ওয়াটার পাইপলাইন বসানো ও সংস্কারের জন্য মোহাম্মদ শফিক, মেসার্স হোসেন এন্টারপ্রাইজ ও মানিক এন্টারপ্রাইজ থেকে দরপ্রস্তাব পায় বাফুফে। প্রতিটি দরপ্রস্তাবই একইরকম। সেখান থেকে টেন্ডার দেয়া হয় মোহাম্মদ শফিককে। নিলাম প্রক্রিয়া অনুযায়ী আড়াই লাখ টাকা দেয়ার কথা বাফুফের। কিন্তু পানির পুরোনো লাইন সংস্কার করার জন্য শফিককে ৫০ লাখ টাকা বেশি দিয়েছে তারা। বাফুফে গঠনতন্ত্রের ৫৯ ধারায়তে লেখা আছে, ফেডারেশনের হিসাব ব্যবস্থাপনা ও ফিফার যোগাযোগের দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদকের। প্রতিটি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় অনিয়মের দায় এড়াতে পারেন না সোহাগ।
এদিকে বাফুফের সভাপতি বলেছেন, আগামীকাল সোমবার ফিফার অফিস খুলবে। আমি ফিফার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলব। এরপর আমরা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবো আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। এ বিষয়ে ফিফা থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। ওরা যখন জুরিখে গিয়েছিল তখন বুঝেছিলাম যে একটা কিছু চলছে। তখনো অফিশিয়ালি আমাকে কেউ জানায়নি। এখনো অফিশিয়ালি আমি ফিফা থেকে কোনো চিঠি পাইনি। ফিফার সিদ্ধান্ত নিয়ে সোহাগের সঙ্গে কথা বলেছি।
সোহাগ মনে করছে, এথিকস কমিটির যে সিদ্ধান্ত তার উপর নিয়েছে সেটি অবিচার করা হয়েছে। এ নিয়ে সে কোর্ট অব আরবিট্রেশন ফর স্পোর্টসে যাবে বলে আমাকে জানিয়েছে। ফিফার এথিকস কমিটি কিন্তু বলে নেই আর্থিক অনিয়ম। রিপোর্টে আর্থিক অনিয়ম বলা হয়নি। ওরা কোড অব এথিক্স ও রেসপনসিবিলিটি নিয়ে বলেছে। অবশ্য, যাই বলা হয়েছে সবই এখানে আসবে। লুকানোর কিছু নাই। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলার আগে আমার সবার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার সব ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সিনিয়র মেম্বারদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সিদ্ধান্ত যেটি হবে সেটিই আমি সবাইকে জানাব।
অন্যদিকে দুর্নীতির অভিযোগে ফিফা কর্তৃক বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগকে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞার শাস্তিকে অবৈধ হিসেবে দাবি করেছেন তিনি নিজেই। একই সাথে তিনি জানিয়েছেন, কোর্ট অব আরবিট্রেশন ফর স্পোর্টস সিএএসে (খেলাধুলা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আদালত) ফিফার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন তিনি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানান আবু নাইম সোহাগের আইনি সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠান এ হোসাইন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। আইন সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ফিফার অ্যাডজুডিকেটরি চেম্বার একটি স্ট্যাম্পিং হাউজের মতো করেই আবু নাঈম সোহাগের বিপক্ষে রায়টি প্রদান করেছে। ফিফা ইনভেস্টিগেটরি চেম্বার তদন্তকালে কোনো স্বাধীন এবং ন্যায়পরায়ণ পদ্ধতি অবলম্বন করেনি।