- হকারদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদে সমাধান হবে না —বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা
রেড, ইয়েলো, গ্রিন তিন জোনে ভাগ করা হবে ফুটপাতগুলো —সম্পত্তি সচিব মুনির হোসেন
রাজধানীতে ফুটপাত দখল করে রমরমা ব্যবসা এখন পুরোনো খবর। হাজার হাজার স্থায়ী-অস্থায়ী বিভিন্ন দোকানের কারণে স্বাচ্ছন্দ্যে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার কোনো অবস্থা নেই। আবার দিনে দিনে এ দখলদারিত্বের সংখ্যা কমে যাওয়ার পরিবর্তে বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ শহরের ভারসাম্য রক্ষায় কারো কোনো দায়িত্ব বা জবাবদিহি নেই। তবে এই ফুটপাত আবার টিকে আছে সাধারণ, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের প্রয়োজনে। মার্কেটে গিয়ে যে দাম দিয়ে একটি পণ্য কিনতে হয়, তার তুলনায় ফুটপাতে অনেক কমে কেনা যায়। এ কারণেই কী আসলে ফুটপাত উদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না? জবাব অনেকটাই ‘হ্যাঁ’। দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে ফুটপাতের ব্যবসা উঠিয়ে দিলেও আবার রাতারাতি বসে যায়। আবার কখনো ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জরিমানা করতেও দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে। এরপরও ফুটপাতে দোকান বা অন্যান্য ব্যবসার নেশা ছাড়ছে না হকারদের। ফলে রাস্তায় চলতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েন পথচারীরা। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি— এমন দাবি ভুক্তভোগীদের। যদিও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন-সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, মেয়রের নির্দেশে ফুটপাতকে কমিয়ে আনতে এবং জনভোগান্তি কমাতে তিন জোনে ভাগ করা হবে সমগ্র ফুটপাত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, মগবাজার, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই ফুটপাত দখল করে হকাররা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। ফুটপাত হলো পায়ে চলার পথ। অথচ এই পথের প্রায় সম্পূর্ণটাই রয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের দখলে। এমনিতেই রাজধানীতে বেড়েছে গাড়ির চাপ, তার ওপর ফুটপাত দখল। এটি দখলমুক্ত করতে সিটি কর্পোরেশনের অভিযানে কোনোই কাজ হচ্ছে না। তাই ঝুঁকি নিয়েই রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে পথচারীদের। তবে সচেতন কিছু সমাজ বিশ্লেষক বলছেন, ফুটপাতের অসুবিধার পাশাপাশি রয়েছে সুবিধাও। সবার পক্ষে মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে ফুটপাতের প্রয়োজনীয়তা অনেক। ফুটপাতের নির্দিষ্ট একটি এলাকার অবস্থা পরিদর্শন করলে পুরান ঢাকার সদরঘাট, ধোলাইখাল, লক্ষ্মীবাজার, ভিক্টোরিয়া পার্ক সংলগ্ন এলাকায় দেখা যায় অনেক ভোগান্তি। আবার এসব স্থানে কেনাকাটায়ও অনেক ভিড় থাকে। যেখানে আশেপাশে রয়েছে অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অথচ এখানে ফুটপাতের সংখ্যাও অনেক বেশি। রাস্তা দখল করে ভাতের হোটেল থেকে শুরু করে সবজি, কসমেটিকস সামগ্রী, চা-সিগারেটের দোকানসহ নানা ধরনের ফাস্টফুডের দোকানে ছেয়ে আছে পুরো এলাকার ফুটপাত। আর এসবের জন্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এ এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সাধারণ মানুষকে। কিন্তু বাস্তবতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যারা সকালে বাচ্চা নিয়ে ফুটপাতের কারণে সমস্যায় পড়ছেন, তারাই সন্ধ্যার পর এখানে এসে কম দামে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনছেন। সুতরাং বলাই চলে, ফুটপাতের সুবিধাভোগী ও ভুক্তভোগী উভয়েই সাধারণ মানুষ।
পুরান ঢাকার নবাবপুর থেকে প্রতিদিন লক্ষ্মীবাজার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ক্লাস করতে আসে লাইমুনা। পঞ্চম শ্রেণির এ শিক্ষার্থীর সঙ্গে আসেন তার মা মাসুমা দেওয়ান। তিনি বলেন, ফুটপাতের দোকানের জন্য আসলে আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থীর অভিভাবককে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে আসতে-যেতে সমস্যা হচ্ছে। আবার এই ভিড়ের মধ্যেই পকেটমার সিন্ডিকেটরাও মাঝেমাঝে মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিচ্ছে পথচারীদের অসতর্কতার সুযোগে। মাসুমা দেওয়ান আমার সংবাদকে বলেন, প্রশাসন যদি ফুটপাত উচ্ছেদে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এ ভোগান্তি কমবে না। আমাদের দাবি, যে কোনো মূল্যে ফুটপাতের ব্যবসা বন্ধ করা হোক। একই সময় দেখা যায় অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে ফুটপাতের ভিড়ের কারণে একপাশে কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আবার পাশের রাস্তা দিয়ে যাবেন, সেখানেও অনেক যানজট। শুধু তাড়া নয়, সেখানে আশেপাশের মহানগর মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী, কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা, উইন্সটন স্কুলের ছোট বাচ্চারা কেউ মা, কেউ বাবা নিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য ভিড় করে আছে। সব মিলিয়ে সেখানে সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ জ্যাম। তাই তাদের সবারই এক কথা— ফুটপাতের নানা ধরনের দোকানের কারণে এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আবার ফুটপাতের কিছু দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিম্নবিত্তসহ মধ্যবিত্তদের নানা ধরনের সস্তায় কেনাকাটার জন্য এ ফুটপাতের দোকানের খুব দরকার। কবি নজরুল কলেজের সামনের এক ফাস্টফুড দোকানদার বলেন, যারাই অভিযোগ করেন আমাদের দোকানের কারণে তাদের সমস্যা হচ্ছে, তারাই আবার দেখবেন সন্ধ্যার পর অথবা বিকালে এখানে কেনাকাটার জন্য ভিড় করেন। মূলত পাবলিকের চাহিদার কারণেই কিন্তু আমাদের এসব ফুটপাতের দোকানের চাহিদা আছে। তারা যদি না কিনতেন, তাহলে এখানে কোনো হকারই বসত না।
ফুটপাতে ব্যবসা কেমন এবং প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কীভাবে হকাররা এখানে বসেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু হকার জানান আসল কাহিনি। তারা বলেন, অধিকাংশ হকারই এখানে দিন এবং সপ্তাহ হিসেবে চাকরি করেন। আসলে এখানে আশেপাশের স্থানীয় কাউন্সিলর, এলাকার প্রভাবশালী সিন্ডিকেটরা পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা করে থাকে। আবার কেউ কেউ এখানে লাইনম্যান নিয়োজিত করে চাঁদা ওঠায়। মাঝে মাঝে পুলিশ এসে উঠে যেতে বলে। কিন্তু আবার টাকা দিলে পাওয়া যায় শিথিলতা। এছাড়াও দিনে দোকানপ্রতি ৫০-১০০ করেও নেয় বলে জানান অনেকে। আবার জানা যায়, প্রভাবশালীরা এখানে ব্যবসার জন্য টাকা দিয়ে লোক ঠিক করে রাখেন; তাদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্ক ভালো থাকায়ও মেলে ফুটপাতে দোকান বসানোর শিথিলতা। যদিও এ চিত্র শুধু পুরান ঢাকায়ই না, সমগ্র ঢাকাতেই দেখা যায় ফুটপাতে ব্যবসার ছড়াছড়ি। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সূত্রাপুর থানার ওসি মইনুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, হকার ও ফুটপাত টিকে আছে সাধারণ মানুষের চাহিদার জন্য। এছাড়াও ঢাকা শহরের এতসংখ্যক হকার্স শ্রেণিকে কোনোরকম কর্মসংস্থান বা পুনর্বাসন না করে মনে হচ্ছে না তাদের উচ্ছেদ করা ঠিক হবে। কারণ তারাও জীবিকার তাগিদে ব্যবসা করছেন। তবে ভোগান্তি যেটা হচ্ছে, সেটা সবার সৃষ্ট; শুধু হকারদের দোষ দিলে বেমানান হবে। মূলত সরকারের কাছে ফুটপাতের হকার্স অ্যাসোসিয়েশন দাবি জানিয়েছে তাদের পুনর্বাসনের। সেটা যদি হয়ে যায়, তাহলে হয়তো ভালো একটা সমাধান হবে রাজধানী ঢাকাকে চাপমুক্ত করার জন্য।
এত অভিযান-জরিমানা করেও ফুটপাত সমস্যার সমাধান কেন হচ্ছে না জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সম্পত্তি সচিব মুনির হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ফুটপাত সমস্যা সমাধানের জন্য মাননীয় মেয়র তিন ভাগে ভাগ করেছেন— রেড, ইয়েলো, গ্রিন। রেড জোনে রয়েছে জিরো পয়েন্ট থেকে হানিফ ফ্লাইওভার পর্যন্ত, যেখানে কোনো ফুটপাতে হকাররা বসতে পারবে না। ইতোমধ্যে সেখানে আমরা বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। পাশাপাশি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আবার ইয়েলো জোনে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বসতে দেয়া হবে। আর গ্রিন জোনে সব সময় ফুটপাতে বসতে পারবে। মুনির হোসেন বলেন, পুরো ব্যবস্থাপনা নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়েছে। এটা নিয়ে এ কমিটির মাধ্যমে কাজ চলছে। তিনটি জোন পুরোপুরি কতদিনের মধ্যে কার্যকর হবে জানতে চাইলে তিনি দক্ষিণ সিটির প্রধান পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। পরবর্তীতে এ নিয়ে সিরাজুল ইসলামকে মুঠোফোনে কল দিলে এ প্রতিবেদকের কল রেকর্ড চালু থাকা বুঝে কিছু না বলেই তিনি কেটে দেন। পরবর্তীতে বারবার কল দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।