- আকু বিল পরিশোধ শেষে নিট রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন
- সুখবর নেই আয় খাতে, ডলার বিক্রি অব্যাহত
- নতুন ঋণের কিস্তি পেলে রিজার্ভ বৃদ্ধির আশা বাংলাদেশ ব্যাংকের
শর্ত পূরণ না হলে ঋণের কিস্তি আটকে যেতে পারে
—আহসান এইচ মনসুর, অর্থনীতিবিদ
রিজার্ভ নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, ধারাবাহিক কমতে থাকা রিজার্ভ এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত মানদণ্ডের নিচে নেমে গেছে। এতে সংস্থাটি থেকে নেয়া ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সাম্প্রতিক পাস হওয়া বেশ কিছু ঋণের কিস্তি শিগগিরই চলে আসবে। এতে রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে সন্তোষজনক অবস্থানে পৌঁছবে। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবণতার পাশাপাশি প্রয়োজন মেটাতে নিয়মিত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশে ব্যাংক। এতে রিজার্ভ ধরে রাখা কঠিন হবে বলে মত অর্থনীতিবিদদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যমতে, গত ২ মে রিজার্ভ ছিল তিন হাজার ৯৮ কোটি ডলার বা ৩০ দশমিক ৯ বিলিয়ন। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি দায় পরিশোধ শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে। এটি রিজার্ভের গ্রস হিসাব। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী (বিপিএম-৬) নিট রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। কারণ রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল, বিমানের ঋণ, পায়রা বন্দরসহ বেশ কিছু খাতে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে রিজার্ভ থেকে। আইএমএফ বলছে, এ অর্থ রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে।
আইএমএফের ঋণের সমঝোতা অনুযায়ী অর্থনীতিতে নীতি ও কাঠামো সংস্কারের একাধিক শর্ত বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। গত নভেম্বরের ঋণ সমঝোতা করার সময় এ কথা জানিয়েছিল আইএমএফ। তখন চলতি বছরের জুন মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি মোতাবেক ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ। নানা কারণে গত জুলাই থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার আগে ও গত অর্থবছরে গড়ে প্রতি মাসে আট বিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় তৈরি হয় বাংলাদেশের। এ হিসাবে তিন মাসের আমদানি দায় মেটাতে নিট রিজার্ভ প্রয়োজন ২৪ বিলিয়ন ডলার। আগামী জুন মাসে এ পরিমাণ রিজার্ভ থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে আইএমএফের বিপিএম-৬ পদ্ধতির হিসাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণের সময় আমরা ২০২৩ সালের জুন মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভকে বাড়িয়ে আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি মোতাবেক ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও মনে হচ্ছে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যও বলছে, আইএমএফের ঋণের কিস্তি ছাড় পাওয়ার শর্ত হিসেবে রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের ওপরে থাকতে হবে। কিন্তু রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যাওয়ায় দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে সমস্যা হতে পারে। একই ধরনের মতামত দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, শুধু রিজার্ভ নয়; আইএমফের দেয়া অনেক শর্তই মানতে বেগ পেতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ শর্ত অপূর্ণ থেকে গেলে ঋণের কিস্তি আটতে যেতে পারে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রিজার্ভ বৃদ্ধি, কর-জিডিপি বৃদ্ধি ও ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বহু বছর ধরেই আমরা বলে আসছি কিন্তু তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। এখন আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসেবে বলছে এসব কথা। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও আইএমএফের মিশন অখুশি বলে মনে হচ্ছে। এসব সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি বদলাতে হবে। আমি আশঙ্কা করছি, এত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে আবার না কিস্তি আটকে যায়। এক-দুটি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে তেমন কিছু হবে না কিন্তু পূরণ না হওয়ার সংখ্যাটি বেশি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বহির্বিশ্বের আস্থায় চির ধরার আশঙ্কা থাকে। প্রশ্ন উঠবে, আসল লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণ না হলে এত বড় ঋণ কর্মসূচি নিয়েই-বা লাভ কী হলো!
অবশ্য কাঙ্ক্ষিত রিজার্ভসহ আইএমএফের সব শর্ত পূরণ না হলেও ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা হবে না বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘সব শর্ত পূরণ না হলে যে ঋণের পরবর্তী কিস্তি পাওয়া যাবে না তা নয়। দেখতে হবে, আমরা ঋণ কর্মসূচির সঠিক পথে রয়েছি কি-না। আমরা এখনো সঠিক পথেই আছি। আগে-পরে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির সব মানদণ্ডেই পৌঁছাতে পারব।’ তিনি জানান, রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত মানে আসতে সময় লাগলেও বিশ্বব্যাংক ও জাইকা যে ঋণ অনুমোদন করেছে তার একটি অংশ আগামী জুন মাসের মধ্যে পেয়ে যাবে বাংলাদেশ; এটি রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া আকু পেমেন্ট হয়ে যাওয়ায় আগামী জুনের মধ্যে বড় কোনো দায় নেই বাংলাদেশের। তবে সদ্য সমাপ্ত এপ্রিল মাসে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ধসের ফলে রিজার্ভে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনের দিকে এ দুটি খাতে কোনো সুখবরও দেখা দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনের দিকে রপ্তানি আয় আরও কমে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান আমার সংবাদকে বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতির কারণে পোশাকের চাহিদা কমছে। এতে রপ্তানি আদেশও কমে যাচ্ছে।
একই সাথে গ্যাস-বিদ্যুত ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাই কম দামের রপ্তানি আদেশ নেয়া যাচ্ছে না। সামনের দিকে রপ্তানি আয় নেতিবাচক ধারায় থাকবে।’ এ ছাড়া হুন্ডির দাপটে রেমিট্যান্সেও ইতিবাচক খবর নেই। নানা সুবিধা দিয়েও ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আনতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন কৌশলে অর্থপাচার ও ডলার মার্কেটে অস্থিরতার কারণে হুন্ডি বাড়ছে। বিপরীতে কমছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। এ দিকে ডলার সঙ্কটের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এলসি খোলার হার কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সরকারি কেনাকাটার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ এলসি খুলছে ওই পরিমাণ ডলার আয় হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলো কাছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এ ডলার বিক্রি হয়েছে রিজার্ভ থেকে।