জোড়াতালি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: মে ১০, ২০২৩, ১১:০৩ পিএম
জোড়াতালি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ

দুই যুগের বেশি সময় ধরে পাইপে জোড়াতালি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করছে তিতাস গ্যাস পরিবহন ও সঞ্চালন ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। সংস্থাটির ৬০ শতাংশ পাইপলাইনই ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৭০ সালে যেসব পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছিল তার টেকনিক্যাল লাইফ ধরা হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ বছর। অর্ধশত বছরের বেশি পুরোনো লাইন দিয়েই চলছে রাজধানীর গ্যাস পরিবহন ও সঞ্চালন ব্যবস্থাপনা। ফলে গ্যাসের লিকেজ হয়ে উঠেছে নগরবাসীর জন্য নিয়মিত ঘটনা। সর্বশেষ এসব পাইপলাইন সংস্কারে ২০১৯ সালে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তিতাস গ্যাস ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। তবে নানা জটিলতায় প্রকল্পটি বেশির ভাগ কাজ এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার গ্যাসের পাইপলাই সংস্কার ও প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে। তবে রাজধানীর সংস্কার প্রকল্পে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সংস্থাটির উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেছেন, ঢাকার আশপাশে অনেক কাজ হলেও শহরের মধ্যের পাইপলাইন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি। শীর্ষ পর্যায়ের অনুমতি পেলে কাজ শুরু হবে। এদিকে ২০ বছর আগেই তিতাস গ্যাসের বেশির ভাগ পাইপলাইনের ‘টেকনিক্যাল লাইফ’ শেষ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জ্বলানি বিশ্লেষকরা। সেই হিসাবে গোটা রাজধানীজুড়ে যে গ্যাস পরিবহন ও সঞ্চালন লাইনের নেটওয়ার্ক রয়েছে তার বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। সমপ্রতি রাজধানীর বেশ কয়েকটি ভবনে বিস্ফোরণে গ্যাস লিকেজের কারণে হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে ওঠে এসেছে। সম্প্রতি রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় তীব্র গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় জ্বালানি বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘কলকারখানা বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত চাপের কারণে পাইপলাইনের লিকেজ দিয়ে গ্যাস নির্গত হয়েছে। তবে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।’ আইন অনুযায়ী, পোস্টপেইড ও প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বাসায় দুই বছরে একবার অথবা বছরে একবার পরিদর্শনে যাওয়ার কথা তিতাসের কর্মীদের। কিন্তু এ নিয়ম মানে না তিতাস। গ্রাহকদের বাসায় গিয়ে নিয়মিত যাচাই করার মতো পরিদর্শনকারী দল নেই প্রতিষ্ঠানটির। বিশ্লেষকরা বলেছেন, গ্যাসের পাইপলাইনের লিকেজ দূর করা না হলে এ সমস্যা যেকোনো সময় হতে পারে। আর এর থেকে ভয়াবহ দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। তাই যত দ্রম্নত সম্ভব এসব পাইপলাইন প্রতিস্থাপন কিংবা সংস্কার প্রয়োজন। তবে রাজধানীতে এ সংস্কার কার্যক্রমে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলেও জানান তারা। তিতাসের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও গ্যাসলাইন সংস্কার বা প্রতিস্থাপন বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ। যার প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো রাজধানীর গ্যাস পাইপলাইনের পরিপূর্ণ কোনো ম্যাপ না থাকা। এ ছাড়াও অসংখ্য বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত থাকা অনেক লাইনের ওপর দিয়ে সড়ক এতটাই উঁচু হয়েছে যে কাজ করা দুষ্কর। এর বাইরে বর্তমানে ঢাকা ও এর আশপাশে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ আছে যেগুলোর লাইন কেটে দেয়া হলেও রাইজার রয়ে গেছে। এগুলো থেকে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। 

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ মোল্লাহ জানান, পুরোনো জরাজীর্ণ গ্যাস বিতরণ লাইন প্রতিস্থাপন, বিদ্যমান লাইনে কোথাও ছিদ্র থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করে মেরামতসহ বেশ কিছু কাজের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ কাজে একটি বিদেশি কোম্পানিকে জরিপের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা অস্থায়ীভাবে বন্ধ গ্যাস সংযোগ চিহ্নিত করেছে।’ বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, ‘বিস্ফোরক কিংবা রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের পাশাপাশি বাতাসে গ্যাসের উপস্থিতিতে অগ্নিকাণ্ড কিংবা বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ হতে পারে। সাধারণত বাতাসে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপস্থিতি ৫ থেকে ৭ শতাংশ এবং এলপিজির উপস্থিতি ২ শতাংশের ওপরে গেলেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম বলেন, ‘পাইপলাইনের প্রত্যেকটা সিলিং নির্দিষ্ট চাপ সহ্য করতে পারে। পুরোনো হওয়ার কারণে সিলিং ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) কমে যায়। গ্যাসের চাপ বেড়ে গেলে বিভিন্ন স্থানে গ্যাস লিকেজ হয়। অথচ এটিই স্বাভাবিক চাপ। এ চাপ সহ্য করতে না পারার ফলে পুরো সিস্টেমের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।’

দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের ঢাকা ও তার চারপাশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা পাইপলাইনের ৬০ শতাংশের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ বছরের পুরোনো পাইপলাইনও রয়েছে। পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ এসব পাইপলাইনে ছিদ্র হয়ে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে গড়ে তোলা অবৈধ পাইপলাইনে ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে নানারকম বিধিনিষিধের কারণে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা বেড়েছে। গ্রাহকের টাকায় প্রতি বছর বিপুল মুনাফা করলেও তিতাসের সেবার মান উন্নত হয়নি। গ্রাহকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। কোনো দুর্ঘটনার পর জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার করা ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ পাইপলাইন পরিবর্তন করা হয়নি। গত অর্থবছরে তিতাসের জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে অভিযোগ আসে ছয় হাজার ৮৬২টি, এর মধ্যে গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্রের ঘটনা চার হাজার ৮৯১টি। আর অগ্নিদুর্ঘটনার ঘটনা ৩১১টি। তিতাসের সর্বশেষ জরিপ অনুসারে তাদের মোট পাইপলাইন রয়েছে ১৩ হাজার ৩২০ কিলোমিটার জুড়ে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রয়েছে ঢাকা মহানগরীতে। গত অর্থবছর ঢাকার এক হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মান পরীক্ষা করে ৪৫৯টি ছিদ্র পাওয়ার কথা জানায় তিতাস। পরে সেগুলো মেরামত করা হয়। ব্যস্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দীর্ঘদিন ধরে তিতাস গ্যাসের সঞ্চালন লাইনে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। বছরখানেক ধরে উপজেলার চন্দ্রা পল্লী বিদ্যুৎ বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকামুখী সড়কের সার্ভিস লেনের পাশে বের হচ্ছে গ্যাসের বুদ্বুদ। এক বছরে বেশ কয়েকবার এখানে আগুন ধরেছে। এরপরও ছিদ্র সারাতে উদ্যোগ নেয়নি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন তারা। সর্বশেষ গত ঈদুল ফিতরের পরদিন সন্ধ্যায় সেখানে আগুন লাগে। এতে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদ পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কালিয়াকৈর স্টেশনের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

সম্প্রতি কোনো রকমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা বাজারে চলছিল তিতাস গ্যাসের লাইন মেরামতের কাজ। এ সময় বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ হয়েছিলেন মেহেদী হাসান শাওন (২৩) নামে এক শিক্ষার্থী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। নিহত মেহেদী হাসান শাওন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত বছরের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে একটি তিনতলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১২ জন মারা যান। আহত হন দুই শতাধিক। ওই ভবনে থাকা অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন একটি গ্যাস সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন না করায় লাইন লিকেজ হয়ে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায়। প্রসঙ্গত, ১৯৬৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে তিতাস গ্যাসের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, তিতাসের মোট পাইপলাইন ১৩,৩২০ কিলোমিটার। গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ। মোট পাইপলাইনের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় সাত হাজার কিলোমিটার। নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর ও কিশোরগঞ্জে তিতাসের পাইপলাইন রয়েছে।