- চার কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
- দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং
- গ্যাসের চুলা জ্বলছে মিটমিট করে
- ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত
- কেরোসিন ও ইনডাকশন কুকারের দোকানে ক্রেতার ভিড়
- অধিকাংশ শিল্প-কারখানা-গণপরিবহন বন্ধ
- গ্রিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তৎপর পিজিসিবি
গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিকহতে দুই সপ্তাহ লাগবে
—বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী
ঘূর্ণিঝড় মোকার প্রভাবে সারা দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। এতে বিপাকে পড়ে সাধারণ মানুষ। বৈরী আবহাওয়া বিবেচনায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয় কক্সবাজার উপকূলে। গতকাল রোববার সকাল থেকে আঘাত হানতে শুরু করবে শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড়। মোকার তাণ্ডব শুরু হওয়ার আগেই প্রভাব ফেলতে শুরু করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে। এর আগে মহেশখালীর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে বন্ধ করা হয়েছে গ্যাস সরবরাহ। ফলে গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ নেমে গেছে অর্ধেকের কাছাকাছি। এতে কমে গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনও। এছাড়া পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় আবাসিক গ্রাহকরাও পড়েছেন বিপাকে। এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় মোকার প্রভাবে কক্সবাজারের মহেশখালীর দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত এই অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কেটে যাওয়া মাত্রই ভাসমান টার্মিনালগুলো পুনঃস্থাপন করে গ্যাস সরবরাহ এবং গ্যাসভিত্তিক বদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করা হবে।’ ঘূর্ণিঝড় মোকার তাণ্ডবের আশঙ্কা থেকে চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ফেনীতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন। এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শঙ্কর মজুমদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ফেনী জেলায় সব ধরনের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সে পর্যন্ত গ্রাহকদের সতর্ক ও নিরাপদে থাকার অনুরোধ জানান এ কর্মকর্তা। দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করা হয় সর্বোচ্চ ২৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে আসে ২২০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা জোগান দেয়া হয় আমদানি করা এলএনজির মাধ্যমে। গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে এক বার্তায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) জানিয়েছে।
বার্তায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম, মেঘনাঘাট, হরিপুর ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। এর ফলে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি ছাড়িয়ে গেছে তিন হাজার মেগাওয়াট। গ্যাসের ঘাটতির কারণে কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। দেশে গত শনিবার দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। কারণ, গ্যাস ঘাটতির কারণে কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডকে (বিপিডিবি) দুপুর ১২টায় প্রায় দুই হাজার ৫১ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে; যখন ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১০ হাজার ৭৪৯ মেগাওয়াট। ঢাকা পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. কাউসার আমীর আলী জানান, ঢাকা মহানগরীতে তার আওতাধীন এলাকায় এক হাজার ১৫৭ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে শনিবার সকাল ১১টায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল ৮১৯ মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় ৩৪৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, তার কোম্পানির আওতাধীন এলাকায় দিনে ৩৫০ থেকে ৩৮০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এলএনজি সরবরাহ তিন দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, রান্নার চুলা, শিল্প-ুকারখানায় সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। আর আগামী দুদিনের মধ্যে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে। গ্যাসের চাপ কমায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে দুদিন ধরে চুলা জ্বালাতে সমস্যায় পড়ছেন ভোক্তারা। গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। তাই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের একটি বড় অঞ্চলে লোডশেডিং চলছে। নসরুল হামিদ বলেন, দুটি ভাসমান টার্মিনালের মধ্যে একটি গভীর সমুদ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। সেটি থেকে এলএনজি সরবরাহ শুরু হতে ১২ থেকে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে। আর যেটি কাছাকাছি আছে, তা থেকে শিগগিরই এলএনজি সরবরাহ শুরু হবে। এতে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে ভালো হবে।
চট্টগ্রামে গ্যাস না থাকায় কেরোসিন ও ইনডাকশন কুকারের দোকানে ভিড় করছেন নগরবাসী। তবে হঠাৎ চাহিদা সামাল দিতে না পারায় অধিকাংশ মানুষকে দোকান থেকে হতাশা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, এসব পণ্যের দাম দেড় থেকে দুইগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা। চট্টগ্রামে অর্ধশতাধিক দোকানের কোনোটিতেই কেরোসিনের চুলা নেই। ইনডাকশন কুকারও শেষ হয়ে গেছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি দোকানে। গ্যাস সংকটের কারণে আবাসিক গ্রাহকরা রান্না করতে পারছেন না। হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাবারের দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া গাড়িতে সিএনজি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় সড়কে কমে গেছে গ্যাসচালিত গাড়ি। ফলে অন্যান্য গাড়ির ভাড়া বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ রাখায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে সিএনজিচালিত গণপরিবহন। বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ শিল্প-কারখানার উৎপাদন। ফলে চারদিকে বিরাজ করছে এক ধরনের গুমোট পরিস্থিতি। জানা যায়, মহেশখালীর গভীর সাগরে থাকা এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ রাখায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে দেশজুড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও গ্রিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তৎপর রয়েছে পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
গতকাল রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে পিজিসিবি জানায়, ঘূর্ণিঝড় মোকার তাণ্ডব শুরু হলেও দেশের সর্বত্র চালু রয়েছে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড। দুর্যোগের সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে যে কোনো রকম অপ্রত্যাশিত তারতম্য ঘটলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লোড ডেসপ্যাচ কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত পিজিসিবির কর্মীরা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছেন। এদিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন ঘটেছে। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাটারিতে ব্যাকআপ ক্ষমতা বেশিক্ষণ না থাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন আইএসপিএবির সভাপতি এমদাদুল হক। তিনি বলেন, আমাদের ইন্টারনেট অপারেটরগুলো ব্যাটারি ব্যাকআপ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ঘন ঘন বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়া বা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় অপারেটরগুলো ব্যাটারি দিয়ে বেশি সময় সেবা চালিয়ে যেতে পারছে না, এজন্য গ্রাহকরা ইন্টারনেট ব্যবহারে সমস্যায় পড়ছেন।