এবিবির সংবাদ সম্মেলন

মাসে পাচার ১৬ হাজার কোটি

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশিত: মে ২২, ২০২৩, ১১:২২ পিএম
মাসে পাচার ১৬ হাজার কোটি
  • বাণিজ্যের আড়ালে কারসাজি করছে বড় শিল্পগ্রুপ
  •  আদালতের স্থগিতাদেশ খেলাপি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা
  •  ডলার সংকটে প্রতি ১০টিতে চারটি এলসি খোলা হচ্ছে

 বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার পাচার হতো। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী দেশীয় মুদ্রায় এ অঙ্ক ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণের পর এটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বড় শিল্পগ্রুপগুলো ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার করত। গতকাল সোমবার ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) আয়োজিত ‘ব্যাংকিং সেক্টর আউটলুক-২০২৩’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

এবিবির এমন তথ্যের সাথে একমত বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্ধারিত মুখপাত্র ছাড়া গণমাধ্যমে বক্তব্য না দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় নাম প্রকাশ না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, ‘পণ্যের দাম কমবেশি দেখিয়ে অর্থপাচারের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে বিপুল এসলি আটকে দেয়া হয়েছে। প্রতি মাসে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এটি অনেকটা কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি।’ এ ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের শিথিলতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন এ কর্মকর্তা। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘আমদানি পণ্যের দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার করা হচ্ছে। তাই বড় অঙ্কের এলসি পরীক্ষা করে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’ এবিবি জানায়, মানুষের আস্থার বড় জায়গা ব্যাংক খাত। এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। তবে মাঝে যে চাপ তৈরি হয়েছিল সে তুলনায় এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ডলারের বাজার পুরোপুরি ঠিক না হলেও আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়েছে। আমানত তুলতে এসে না পাওয়ার ঘটনা নেই; বরং উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়েও আমানত বেড়েছে। ঋণে প্রবৃদ্ধি আছে। সংগঠনটি আরও জানিয়েছে শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষে দেশের ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তারা মনে করে, এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় ব্যাংকারদের কিছু করার থাকে না। যেমন শক্তিশালী কিছু বৃহৎ শিল্পগ্রুপ ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আইনি জটিলতার কারণে সেই টাকা আদায় করতে পারে না ব্যাংক। একইভাবে খেলাপির নাম প্রকাশ করাও সম্ভব হয় না। ব্যাংক কোম্পানি আইন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন না থাকাটাও এখানে বড় বাধা। তাই দেশের স্বার্থেই সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসাইন বলেন, ‘অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতি সংশোধনের মাধ্যমে আমদানিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ফলে প্রতি মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার অবৈধ লেনদেন বন্ধ হয়েছে।’ রেমিট্যান্স নিয়ে তিনি বলেন, ‘ডলারের শুধু দাম নির্ধারণ করলেই হবে না, রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের কী ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে তাও দেখতে। তাদের যোগ্য সম্মান দেয়া হয় না; বরং বিমানবন্দর থেকে শুরু করে নানা জায়গায় তারা বঞ্চনার শিকার হন। তাদের কোনো ধরনের কাজ শেখানো হয় না। অন্যান্য দেশে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দেয়া হয়, দক্ষ করা হয়, যা আমাদের দেয়া হয় না। এতে প্রবাসীরা অনেক পিছিয়ে পড়ছেন।’

তিনি আরও বলেন, আগামী জুলাই থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিশেষত ডলারের একক দামে বেচাকেনা শুরু হবে। এটি বাজারের ওপরে ছেড়ে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়া কতটুকু প্রয়োজন তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত। বেঁধে দেয়া সুদহার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। আসছে মুদ্রানীতিতে যদি সুদহারের ক্যাপ তুলে দেয়া হয় তবুও সেটি বাজারভিত্তিক হবে না। তবে এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই ধরে নেয়া হবে। তিনি বলেন, ২০২২ সালে যে অর্থনৈতিক মন্দা, সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ, রিজার্ভের সংকট গেছে, তা গত ৩৫ বছরে দেখেনি দেশের ব্যাংক খাত। গেলো বছরের জুন-জুলাইয়ে ভয়াবহ মন্দায় গেছে দেশ। এ বছরই টাকার মান কমেছে ২৫ শতাংশ, যা অকল্পনীয়।

এক প্রশ্নের উত্তরে এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশে মুদ্রা সরবরাহই উচ্চ মূল্যস্ফীতির একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। এখানে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সংস্কারের দরকার আছে। কেননা, এখন তো বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমছে। অথচ আমাদের চিনি কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি দরে।’ সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন বলেন, আগে আমাদের প্রতি মাসে সাত বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো, কিন্তু তা এখন কমে সাড়ে চার বিলিয়নে এসেছে। কমে যাওয়া আড়াই বিলিয়নের মধ্যে এক বিলিয়ন তৈরি পোশাক খাতের মেশিনারিজ আমদানি এবং বাকি দেড় বিলিয়নের মধ্যে ওভার ইনভয়েসিং হতো। যা এখন কমে এসেছে।’ ব্যাংকের মাধ্যমেই অর্থপাচার হচ্ছে— ব্যাংকাররা এ দায় এড়াতে পারেন কি-না, এমন এক প্রশ্নে মাশরুর আরেফীন বলেন, ‘এখন আর ব্যাংকারদের বিশ্বাস করা যাচ্ছে না বলেই বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের দায়বদ্ধতার ঘাটতি ছিল।’ মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে এখনো এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। ছোট ছোট এলসিগুলো খুলতে পারছি না। আমাদের কাছে ১০টি এলে হয়তো চারটি এলসি খুলতে পারছি। তবে আমাদের ভালো দিক হলো এক্সপোর্ট বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে। করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতিতেও অর্থনৈতিক মন্দায় কাটিয়ে উঠতে শুরু করছে ব্যাংক খাত। এখন আমানত বাড়ছে কিন্তু সে তুলনায় ঋণ বিতরণ কমেছে। এখন অতিরিক্ত এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা তারল্য রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে জরুরি পণ্যের এলসি খোলাই এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের আগে খেলনা আমদানির প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের সার দরকার, তেল দরকার। আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বেড়েছে। রেমিট্যান্সে ডলারের রেট ৮৭ টাকা থেকে ১০৮ টাকা হয়েছে। আমাদের সাময়িক তারল্য সংকট দেখা দিয়েছিল। তবে এখন অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী বলেন, ‘এমডিদের ওপর পর্ষদের চাপ নেই। পর্ষদ আমাদের ডিস্টার্ব করে না। তবে পরামর্শ দেয়।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সুবিধা নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গ্রাহকরা একযোগে বিপুল অর্থ উত্তোলনের কারণে সংকট তৈরি হয়েছিল। পুরো ব্যাংকিং খাতের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের তারল্য সুবিধা দিয়েছে। জনগণের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করেছে।’ সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ডাচ বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন ও মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি মো. আহসানুউজ জামান।