- বরিশাল ও খুলনায় সবার মুখেমুখে আজমত উল্লার ভরাডুবির কথা
- বরিশালে প্রকাশ্যে চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্ব-বিভেদ কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে
- খুলনায় বিএনপির ভোট ব্যাংক বেশি, কেন্দ্রে না যেতে দলীয় প্রচারণা
- বরিশালে মোট ভোটার দুই লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন
- খুলনায় মোট ভোটার পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন
আগামীকাল ১২ জুন বরিশাল ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন। এ দুই সিটিতেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গাজীপুরের ভরাডুবির আতঙ্কে রয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দৃশ্যমান সর্বশক্তি নিয়োগের পরও আওয়ামী লীগের সৎ, সজ্জন হিসেবে পরিচিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান হেরে গেছেন। দলটির নেতারা বলছেন, গাজীপুরের মতো বাকি চার সিটিতেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে রাজশাহী ও খুলনায় ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান ভালো হলেও বরিশালে ততটা সুবিধাজনক নয়। জানা গেছে, গাজীপুরের মতো বরিশালে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী না থাকলেও দলে আছে দ্বন্দ্ব-বিভেদ। পাশপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলনের মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম শক্তিশালী প্রার্থী। এমন বাস্তবতায় ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে গাজীপুরের মতো বরিশালেও পরাজয় ঘটতে পারে আওয়ামী লীগের, ডুবতে পারে নৌকা।
এ নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বরিশালের সন্তান জাহাঙ্গীর কবির নানক। দলের পক্ষে বরিশালে কেন্দ্রীয় প্রচার কমিটিতেও রয়েছেন তিনি। বরিশাল সিটিতে এবার বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুুল্লাহর বদলে মনোনয়ন পেয়েছেন তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। এ নিয়ে চাচা-ভাতিজার মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পেয়েছে। সাদিক আব্দুল্লাহ বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিপুল সংখ্যক অনুসারী রয়েছে তার। তার বাবা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। তাকেই কেন্দ্রীয় প্রচার প্রতিনিধি দলের প্রধান করা হয়েছে। তিনি ভাইকে নিয়ে একাধিক দলীয় কর্মসূচিও পালন করছেন; করেছেন কোলাকুলিও, তবে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলেছে, এ বিভেদ মেটার নয়। বরিশালের প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারী নেতাকর্মী ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থক নেতাকর্মীরা খোকন সেরনিয়াবাতকে সমর্থন দিচ্ছেন, কিন্তু বরিশালের প্রার্থীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কম। এক সময় তিনি যুবলীগের সদস্য থাকলেও পরবর্তী সময়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে যান। এদিকে চাচা-ভাতিজার মন কষাকষির পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার বিরোধিতাও এখন বরিশালের মানুষের মুখে মুখে। সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা প্রথম দিকে নির্বাচনি মাঠে না থাকলেও এখন দৃশ্যমান। তবুও সংশয় রয়েই যায় যে, তারা আদৌ আন্তরিকভাবে কাজ করবেন কি-না। কেননা, সাদিক চাচার পক্ষে ঢাকা থেকে বৈঠকে যোগ দিলেও শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে দুই পক্ষ আলাদা কর্মসূচি পালন করে। এতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে, মামলা হয়। এর আগে খোকনের মনোনয়ন ঘোষণার পরও এক দফা সংঘর্ষ হয়। তখন থেকে কিছু নেতাকর্মী এখনও জেলে রয়েছেন।
কাল ১২ জুন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ৩০টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার দুই লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন এবং নারী ভোটার এক লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ জন। নির্বাচনে সাতজন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া ৩০টি ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৯ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ১০টি পদের বিপরীতে ৪২ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনের মোট ১২৬টি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আজ ট্রায়াল দিয়ে দেখা হবে। এবারের নির্বাচনে মোট ৮৯৪টি কক্ষে ভোট গ্রহণ করা হবে, ‘প্রতিটি ভোটকক্ষে একটি করে এবং প্রতিটি কেন্দ্রের প্রবেশপথে দুটি করে ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। এতে মোট এক হাজার ১৪৬টি ক্যামেরা থাকবে। এবার ভোটার দুই লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। নারী এক লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ আর পুরুষ এক লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন। তাদের ভোট দেয়ার জন্য নগরীর ১২৬টি কেন্দ্রের ৮৯৪টি বুথ প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে প্রবেশপথে এবং বুথকক্ষে স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা। সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশে ভোট গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন বিসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির।
নতুন বরিশাল গড়তে ভোট চাইছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত। উৎপাদনমুখী এবং আইটি সিটি গড়তে ভোট চাইছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস। অন্যদিকে শান্তিময় শিক্ষার নগরী গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করীম। এদিকে সরকারবিরোধী ভোট চাইছেন বিএনপির প্রয়াত মেয়রপুত্র কামরুল আহসান রূপন। অন্য তিন প্রার্থীও ভোট চাইছেন নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনের মাঠে কাজ করছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনসহ অনেকে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিভাগের ছয় জেলার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
১২৬ কেন্দ্রের মধ্যে ১০৬টি ঝুঁকিপূর্ণ : বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ১২৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৬টি কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) কমিশনার সাইফুল ইসলাম। গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সাইফুল ইসলাম বলেন, মধ্যরাতের পরে অভিযান পরিচালনা করা হবে। কোনো বৈধ কারণ ছাড়া বহিরাগতকে শহরে থাকতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, বাইরে থেকে যারা এসেছেন তারাও থাকতে পারবেন না। চিকিৎসার মতো বৈধ কারণ না থাকলে আমরা কাউকে থাকতে দেবো না। তবে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকলে সে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। পুলিশ কমিশনার বলেন, ভোটাররা যেন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা হবে। এ জন্য নির্বাচনের দিন পুলিশ, র্যাব, এবিপিএন ও আনসার মিলিয়ে মোট চার হাজার ৪০০ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, বরিশালের মানুষ তাকে গ্রহণ করেছে। তারা উপলব্ধি করেছে নৌকা জিতলে বরিশালের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব। খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, ‘নির্বাচিত হয়ে আমি বরিশালের মানুষের সেবা করতে চাই। আমি তাদের নেতা হতে চাই।’ বরিশাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং নতুন বরিশাল গড়তে ১২ জুন নৌকায় ভোট চান তিনি। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, আওয়ামী লীগ হাজার হাজার বহিরাগত বরিশাল নগরীতে জড়ো করেছে। তারা ২০১৮ সালের মতো ভোট ডাকাতির পাঁয়তারা করছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা আছে। ইভিএমে কারচুপির আশঙ্কা রয়েছে। ভোটের ফল ঘোষণার আগে শঙ্কামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত দেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলবেন তিনি।
মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকাও অনাগ্রহের আরেকটি কারণ। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আগ্রহ-আবেগ সৃষ্টি হয়েছিল। এরপরও গাজীপুরে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েনি। ওই নির্বাচনে হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। খুলনায় এমন প্রার্থীও নেই। জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাকের পার্টির প্রার্থী থাকলেও এ দলগুলোর অতীতের নির্বাচনে ভোটের পরিসংখ্যান আশাব্যঞ্জক নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন চার লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। ভোট পড়েছিল ৫৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক এক লাখ ৭৬ হাজার ৯০২ ভোট ও বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু পেয়েছিলেন এক লাখ ৯ হাজার ২৫১ ভোট। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুজ্জাম্মিল হক ১৪ হাজার ৩৬৩ ও জাতীয় পার্টির এস এম মুশফিকুর রহমান এক হাজার ৭২ ভোট পেয়েছিলেন। এবার দুটি দলই প্রার্থী বদল করেছে। জাকের পার্টির প্রার্থীর পাশাপাশি একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছেন। এবার ভোটার পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৩ এবং নারী দুই লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬ জন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র নাসিরউদ্দিন বলেন, গত সিটি নির্বাচনে অনেক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পেরে ফিরে এসেছেন। এবারও সে শঙ্কা থাকায় ভোটাররা বিমুখ থাকবেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত : কেসিসি নির্বাচনে দুটি ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুই আওয়ামী লীগ নেতা কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তারা হলেন— নগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে এসএম খুরশিদ আহম্মেদ টোনা ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে। এসএম খুরশিদ আহম্মেদ টোনা ১৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও জেড এ মাহমুদ ডন মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। জানা যায়, গত ১৬ মে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে একজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ঋণখেলাপির কারণে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মো. শমসের আলী মিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। আপিলেও তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, এ দুটি ওয়ার্ডে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় দুজনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে।
মেয়র ও কাউন্সিলরসহ প্রার্থী ১৮০ : কেসিসি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী পাঁচজন, ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ১৩৬ জন এবং ১০টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ৩৯ জনসহ ১৮০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মেয়র প্রার্থীরা হলেন— আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুদকার আব্দুল খালেক (নৌকা), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মাওলানা আব্দুল আউয়াল (হাতপাখা), জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মধু (লাঙ্গল), জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী এস এম সাব্বির হোসেন (গোলাপ ফুল) ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান (টেবিল ঘড়ি)।