- লোডশেডিং ফের বৃদ্ধির শঙ্কা
- দেশে ডলার সংকট বিদ্যমান
- জ্বালানি মজুত অপ্রতুল
- ফার্নেস অয়েলের চালানে বিলম্ব
- বাড়ছে দেশের তাপমাত্রা
- প্লান্টগুলোর মেশিনেও ত্রুটি
বৃষ্টির মধ্যেও প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং
ঘাটতি দূর করতে নিজেদের গ্যাস ও কয়লা ব্যবহার এবং সৌরবিদ্যুতের দিকে জোর দেয়া হলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না
—ম তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েট অধ্যাপক
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লোডশেডিং কমে এসেছে। এতে স্বস্তি ফিরেছে জনজীবনে। তবে শিগগিরই আগের মতো লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বে পুরো দেশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমি বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তাপমাত্রা কমে বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে। এতে লোডশেডিং আগের চেয়ে বেশ কমে এসেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার সারা দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল এক হাজার ৯৭১ মেগাওয়াট।
এর আগে সোমবার এক হাজার ৩৩৮ মেগাওয়াট, রোববার ২৯৪ মেগাওয়াট ও গত শনিবার বিকেল ৫টার সময় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৬৭০ মেগাওয়াট। উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৫৬০ মেগাওয়াট। এই সময় লোডশেডিং ছিল মাত্র ১১০ মেগাওয়াট। তার তিন দিন আগেও দিনের এই সময়ে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং ছিল। গত দুই সপ্তাহ ধরে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে দুই সপ্তাহ ধরে চলা তাপপ্রবাহ কমেছে। ফলে কমেছে বিদ্যুতের চাহিদাও। এদিকে জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে ভারতের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদিত বাড়তি বিদ্যুৎ। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন বাড়াতে পারছিল না। এতে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ঘাটতি ছিল তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো। এই ঘাটতি পূরণে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লোডশেডিং করতে হয় দেশের ছয়টি বিতরণ কোম্পানিকে। ঢাকায় গড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হলেও বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছিল।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের (পিজিসিবি) বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ঢাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলা জানা যায়, বেশ কয়েক দিন রাজধানী প্রায় লোডশেডিংমুক্ত। ডিপিডিসি ও ডেসকো কর্মকর্তারা জানান, লোডশেডিংয়ের যে তীব্রতা ছিল ঢাকায় সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রচুর গ্রাহক ফোন করছিলেন। অনেক গ্রাহক অভিযোগ করছিলেন, তাদের এলাকায় চার-পাঁচ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীতে জন সন্তোষ প্রশমনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ বিভাগ, ঢাকার দুটি বিতরণ সংস্থা ও পিজিসিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকায় যেভাবে দিন দিন লোডশেডিং বাড়ছিল সেটি ফলে সাধারণ মানুষ ফুঁসে উঠছিল। এ ছাড়া দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও শুরু হয়ে গেছে। জনসাধারণের এসব অসন্তোষ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে বিদ্যুতের দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে হারিকেন মিছিলও করে বিএনপি। সেই সঙ্গে ডিপিডিসি এ ডেসকোতে বিপুলসংখ্যক ক্ষুব্ধ গ্রাহকের ফোনকল আসছিল। লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বিদ্যুৎ অফিস ও উৎপাদন কেন্দ্রে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি চক্র। সমপ্রতি এমন তথ্য পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা।
এদিকে আদানির বিদ্যুতের সরবরাহ বেড়েছে। ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানি গ্রুপের চালু প্রথম ইউনিট থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। গত বুধবার থেকে দ্বিতীয় ইউনিটের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে। এতে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটটি পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হচ্ছে। দুই ইউনিট থেকে এখন এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ আসছে। এ ছাড়া রামপাল-মাতারবাড়ীতে কয়লা এলেও তা বেশি দিন যাবে না। অল্প দিনেই কয়লা ফুরিয়ে যাবে। এদিকে ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলতে ব্যর্থ হচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (আইপিপি)। ফলে তারা ফার্নেস অয়েলের জন্য মুখাপেক্ষী হচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) দিকে। আর এসব কারণে সহসাই লোডশেডিংয়ে ফিরতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিপিসি-পিডিবি সংশ্লিষ্টরা। আইপিপিগুলো বলছে, সরকারের কাছে তাদের বকেয়া পাওনা ১৮ হাজার কোটি টাকা।
চলমান ডলার সংকটে বাংলাদেশ ব্যাংকে পক্ষে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করাও সম্ভব না। ফলে জ্বালানি আমাদানি করাও কঠিন হয়ে পড়বে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। ফলে শিগগিরই বড় ধরনের লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হবে ২০ কোটি মানুষ। তবে মার্চ মাসে পিডিবি চাহিদা দিলেও সে অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল সরবরাহ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বিপিসি। এ নিয়ে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যেও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে জুন মাসের শুরুতে ফার্নেস অয়েল আমদানির কোনো চালান দেশে আসছে না। এতে ফার্নেস অয়েলের মজুতও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এ নিয়ে বিপিসির কেউ মুখ খুলছে না। তথ্য গোপন করে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত এপ্রিল মাসে এক লাখ ৪০ হাজার টন এবং মে মাসে এক লাখ ৩০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ছিল পিডিবির। এর মধ্যে মে মাসেও ৭৬ হাজার টনের মতো সরবরাহ দিতে পেরেছে বিপিসি।
সর্বশেষ গত সোমবারের তথ্য অনুযায়ী, বিপিসিতে ফার্নেস অয়েলের মজুত দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ১২৭ টনে। চলতি জুন মাসের ১৮ তারিখের আগে ফার্নেস অয়েলের কোনো চালান দেশে আসছে না। চলতি জুন মাসে এক লাখ ২০ হাজার এবং জুলাই মাসেও এক লাখ ১০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা রয়েছে পিডিবির। এদিকে পিডিবির কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে তারা জানায়, দেশে জ্বালানি সংকট প্রকট। এ ছাড়া বিদ্যুতের প্ল্যান্টগুলোর মেশিনেও কিছু ত্রুটি রয়েছে। চলমান লোডশেডিং পরিস্থিতি সামলাতে সমপ্রতি বৈঠক করেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংকট মেটাতে দেশি-বিদেশি কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি বিদ্যুৎ কেনা হবে। বর্তমানে ভারতের আদানি গ্রুপ ৭৫০ থেকে ৯৫০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ দিচ্ছে। এখন সরকার আদানির কাছ থেকে এক হাজার ৫০ মেগাওয়াট নিতে চাইছে। রামপাল কেন্দ্র এখন ৩২০ থেকে ৩৭০ মেগাওয়াট দিচ্ছে। তা বাড়িয়ে ৬১২ মেগাওয়াট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ, টঙ্গী, ভেড়ামারা, সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন প্লান্টে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ বাড়িয়ে ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের জন্য বর্তমানে দৈনিক ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে পেট্রোবাংলা। এর পরিমাণ বাড়াতে গেলে শিল্পে সরবরাহ কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. ম. তামিম মনে করেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির অর্থ জোগান দিতে যে আমরা বিপদে পড়তে পারি, সেই আশঙ্কা আগেই ছিল। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আমাদের যে পরিকল্পনা, তাতে আমার হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ ৯০ শতাংশই আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কথা। বুয়েটের এই অধ্যাপক আমার সংবাদকে জানান, আমাদের উচিত ছিল আমদানির পাশাপাশি নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া। ২০১৮ সালে আমরা এলএনজি আমদানি শুরু করেছি। তখন বলা হয়েছে আমাদের নিজস্ব উৎপাদনে সময় লাগবে। এই যুক্তি দিয়ে আমরা সমান্তরালভাবে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধানের দিকে নজর না দিয়ে পুরোপুরি আমদানিনির্ভরতার দিকে ঝুঁকেছি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী তামিম আরও বলেন, গত ২০ বছরে একেক সময়ে একেক কারণে বাংলাদেশে কোনো গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের নিজস্ব প্রাথমিক জ্বালানি তিনটি গ্যাস, কয়লা ও সৌরশক্তি। বিদ্যুতের ঘাটতি দূর করতে নিজেদের গ্যাস ও কয়লা ব্যবহার এবং সৌরবিদ্যুতের দিকে জোর নজর দেয়া হতো, তাহলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না।’