- গ্যাসের জোগান না দিলে বন্ধ হবে কেন্দ্র
- শর্তানুযায়ী গুনতে হবে ক্যাপাসিটি চার্জ
- ডলার সংকটে এলএনজি নিয়ে বড় বিপদ
সরকার ডিজেলের ওপর চাপ কমিয়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে নজর দিয়েছে। গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোতে সর্বোচ্চ জ্বালানি সরবরাহের চেষ্টা করছে সরকার। এদিকে চলতি বছরের শেষনাগাদ গ্যাসভিত্তিক চার বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপানে যাওয়ার অপেক্ষায়। প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম প্রায় শেষদিকে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এসব কেন্দ্র থেকে ২৭০১ মেঘগওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। চলতি বছরের শেষনাগাদ এগুলো উৎপাদনে আসবে। পিডিবি এবং বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানিয়েছেন, চলতি বছর আমাদের বড় বড় কয়েকটি বেইজ লোড বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। এগুলো যথাসময়ে উৎপাদনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পিডিবি সূত্রমতে, বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও খুলনা— এই চার কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের (ইউএমপিএল) ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি কেন্দ্র রয়েছে। ২০১৯ সালে ইউএমপিএলের সঙ্গে পিডিবির চুক্তি সই হয়। এখান থেকে ২২ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ কিনতে চুক্তি করেছে পিডিবি। নারায়ণগঞ্জের ১৯ একর জমির ওপর কেন্দ্রটি নির্মিত হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২০ মিলিয়ন ডলার। চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটি ২০২২ সালে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও নানা সংকটে উৎপাদনে যেতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের এই কেন্দ্রটি চলতি বছরের শেষ নাগাদ উৎপাদনে আসবে বলে জানা যায়।
এদিকে সামিট পাওয়ার একই জেলার মেঘনাঘাটে দ্বিতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৫৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজ করে যাচ্ছে। সামিট গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার ও যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই) যৌথ উদ্যোগে কাজ করছে। ২০১৯ সালে এই দুই কোম্পানি মিলে ‘সামিট মেঘনাঘাট টু পাওয়ার লিমিটেড’ নামে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করেছে। তখন বলা হয়, আগামী তিন বছরের মধ্যে নতুন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাবে বলে আশা করছে কনসোর্টিয়াম। কোম্পানি দুটি ২০১৯ সালে পিডিবির সঙ্গে ২২ বছর মেয়াদে ক্রয় চুক্তি (পিপিএ), ভূমি ইজারা চুক্তি, তিতাস গ্যাসের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহ চুক্তি এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বাস্তবায়ন চুক্তি করে।
নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে এলএনজি/গ্যাসভিত্তিক অপর কেন্দ্রটি ৭১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে রিলায়েন্স বাংলাদেশ এলএনজি অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড। ২০১৯ সালের চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটি তিন বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা।
অন্যদিকে খুলনায় ৪০০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিটে মোট ৮০০ মেগাওয়াটের দ্বৈত জ্বালানির কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে থাকা নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল)।
এদিকে সরকার গ্যাসচালিত বিদ্যুতের দিকে নজর দিলেও ভয় কিন্তু থেকেই যায়। কারণ আমাদের এলএনজি আমদানি করতে হবে। আবার এদিকে ডলার রিজার্ভও সংকটে। এ যেন মাথা ঢাকলে পা খোলা থাকে, পা ঢেকে রাখলে মাথা খোলা রাখতে হচ্ছে। এদিকে ১০০ মেগাওয়াটের একটি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দৈনিক অন্তত ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। সে হিসেবে দেশে বিভিন্ন কেন্দ্রে নির্মাণাধীন ৩০৬১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দৈনিক অন্তত ৬১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। পৃথকভাবে দেখলে সামিটের জন্য দরকার ১১৬ মিলিয়ন ঘনফুট, ইউনিক পাওয়ারের জন্য ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট, রিলায়েন্সের জন্য ১৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট, এনডব্লিউপিজিসিএলের জন্য ১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
এখন সব মিলিয়ে দেশীয় উৎস থেকে দৈনিক ২১০০ থেকে ২২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এছাড়া এলএনজি থেকে আসে আরও ৬৫০ থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। অর্থাৎ দৈনিক যে ২৭০০ থেকে ২৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশই আমদানি করা। দেশে দুটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। যেগুলো দিয়ে দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে শুরু হলে পরে উৎপাদন বন্ধ হলেও গুনতে হবে ক্যাপসিটি চার্জ। আর উৎপাদন বন্ধ হবে— এটাই স্বাভাবিক। কারণ, দেশে তীব্র ডলার সংকট রয়েছে। আর ডলার সংকটে পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় বহু কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। চলমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন পরিস্থিতি নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমাদের গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১০০০ মেগাওয়াট। আমরা ৬০০০ থেকে ৬৫০০ মেগাওয়াট গ্যাস দিয়ে উৎপাদন করছি। এসব কেন্দ্রে উৎপাদন কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জ্বালানি সংকটকে দায়ী করেন। এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার মতো গ্যাস নেই পেট্রোবাংলার কাছে। আমদানিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভর করেই উৎপাদন হচ্ছে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। এর ওপর গ্যাস চালিত আরও চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। গ্যাসের তীব্র সংকটের মধ্যে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র কীভাবে উৎপাদনে যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে এখন গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১০০০ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাসের অভাবে এসব কেন্দ্র থেকে ৬৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এলএনজি সরবরাহ কমে গেলে উৎপাদনও কমে যায়। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, উৎপাদনে যাওয়ার পর ফের বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এটাই মনে হয়।
এ প্রসঙ্গে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ জানান, চুক্তি অনুযায়ী আমরা গ্যাস দিতে বাধ্য। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ যে দেব, তেমন গ্যাস তো নেই। তিনি বলেন, এসব কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দিতে হলে নতুন একটি পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক রহমত উল্লাহ বলেন, বসে বসে ক্যাপাসিটি চার্জ এখন একটা ভালো ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এসব কেন্দ্র উৎপাদনে থাকুক বা না থাকুক, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ঠিকই দিয়ে যেতে হবে। একবার এ ধরনের কেন্দ্র উৎপাদনে এলে শর্ত অনুযায়ী সেটিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসেইন বলেন, চলমান প্রকল্পের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে সংকট বেশ কিছুটা কমে আসবে। তবে গ্যাসভিত্তিক এই কেন্দ্রগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা গ্যাসপ্রাপ্তি। আমরা আশা করছি পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া গেলে সহজেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে।