- সিটি ভোটে অংশ না নিয়েও আলোচনায় বিএনপি-জামায়াত
- দ্বাদশ ভোটের গ্রহণযোগ্যতায় ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়াল শেষ সিটি ভোট
- আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত মনে করা হচ্ছে
- কাউন্সিলর প্রার্থীরাই উৎসবমুখর ভোটে আলোচনায়
- ভোটার উপস্থিতি, নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইসির জোরালো তৎপরতা
আজ সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। এবারের ভোটে বিএনপি-জামায়াতের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দল অংশ না নিলেও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ভোট গ্রহণের সব প্রস্তুতি। তবে শীর্ষ এ দল দুটো অংশগ্রহণ না করলেও আলোচনায় রয়েছে ভোটের মাঠে। আজ বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলবে ইভিএমে। তিন সিটিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পর এবার সিলেট ও রাজশাহী সিটির ভোট কেমন হয়, সবার দৃষ্টি সেদিকে। মনে করা হচ্ছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এ দুই সিটির ভোটই হবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য শেষ পরীক্ষা।
তাই এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে ইসি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। মাঠে নামানো হয়েছে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে। ইসি জানিয়েছে, আজ দুই সিটিতে পূর্বের মতো উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হবে । এর আগের দুই ধাপে অনুষ্ঠিত তিন সিটি অর্থাৎ গাজীপুর এবং বরিশাল ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণভাবে করে নির্বাচন কমিশন নিজেদের ইমেজ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে শেষ ধাপের দুই সিটি অর্থাৎ সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারলেই বর্তমান নির্বাচন কমিশন শেষ অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। তাই শেষ পর্যন্ত দুই সিটির নির্বাচন ইসি সুষ্ঠুভাবে করতে পারে কি না, আর এ নির্বাচনের ফলাফল কী হয়— তা দেখার জন্য সবার দৃষ্টি এখন সিলেট ও রাজশাহীতে। তবে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার, সবই করেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ নির্বাচন এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় মেয়র পদে দুই সিটিতেই আওয়ামী লীগের বিজয় প্রায় নিশ্চিত বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। তবে শেষ মুহূর্তে জাতীয় পার্টি সরকারবিরোধী ভোট টানার চেষ্টা করছে। সূত্র জানায়, সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে তেমন উত্তেজনা না থাকলেও কাউন্সিলর পদের প্রার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে তুমুল উত্তেজনা। কারণ, মেয়র পদে বিএনপি ও জামায়াত অংশ না নিলেও কাউন্সিলর পদে এ দুই দলসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছেন অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীও। তাই মূলত কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণেই দুই সিটির ভোট হবে উৎসবমুখর। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করবেন। গত সোমবার নির্বাচনি প্রচারের শেষ দিনে সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা বিশাল শোডাউন করেছেন। তার আগে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণায়ও তারা নগরবাসীকে বিভিন্ন সেবা বৃদ্ধি এবং ব্যাপক উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছেন।
অন্যান্য প্রার্থীর তুলনায় বেশি যোগ্য প্রার্থী দেয়া, দল ক্ষমতায় থাকায় এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন ও দলের অনেক নেতাকর্মী নৌকার পক্ষে মাঠে সক্রিয় থাকায় দুই সিটিতেই আওয়ামী লীগের বিজয় প্রায় নিশ্চিত বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীসহ অন্যান্য মেয়র প্রার্থী নিজ নিজ সাধ্যমতো ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তাদের চেষ্টা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মতো এত জোরালো নয় বলে দুই সিটিবাসীদের মধ্যে অনেকেই মনে করছেন। তবে দুই সিটিতে শেষ মুহূর্তে এসে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীরা বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলের ভোট টানার চেষ্টা করছেন। এ চেষ্টায় সফল হতে পারলে ভোটের সমীকরণ পালটে যেতে পারে। বিএনপি প্রকাশ্যে দলের নেতাকর্মীদের ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে মানা করলেও বাস্তবে ভেতরে ভেতরে কী করে, সেদিকে অনেকেরই দৃষ্টি রয়েছে। এবার সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে মেয়র প্রার্থীদের চেয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীরা বেশি ভোটারের কাছে গেছেন এবং ভোট পাওয়ার জন্য নানা কৌশলে প্রচার চালিয়েছেন। এই কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি আশানুরূপ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তারা ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছেন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। বিএনপি গাজীপুর, বরিশাল ও খুলনার মতো এ দুই সিটির নির্বাচনে অংশ না নিলেও এতে কেমন ভোট হয়— সেদিকে তীক্ষ নজর রাখছে। কারণ, এ নির্বাচনের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে তাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও এ নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করতে পারবে। এ ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও এ নির্বাচনকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছে।
ইসিতে যত প্রস্তুতি : অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট করতে ইসির নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ইতোমধ্যেই জোরদার করেছে। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয়েছে সমগ্র সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকা। কেন্দ্রে কেন্দ্রে স্থাপন করা হচ্ছে সিসিক্যামেরা। আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে বিশাল স্ক্রিনে ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ইসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দুই সিটি নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে বিজিপি, র্যাব, পুলিশ ও আনসার বাহিনী এলাকায় সক্রিয় থাকবে। বিজিবি ও র্যাব সার্বক্ষণিকভাবে টহল দেবে। পুলিশ ও আনসার বাহিনী কেন্দ্রে কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবে। আর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ বাহিনীও। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ ও সাধারণ কেন্দ্রে ১৬ জন করে ফোর্স থাকবে। এভাবে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে থাকছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ত্রিস্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয়।
দৃষ্টি এখন দুই সিটিতে : এবার সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে ভোট হবে ইভিএমে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে এবার মেয়র পদে লড়ছেন চারজন। এ ছাড়া ৩০ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১২ ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৪৬ জন নির্বাচন করছেন। এই সিটিতে ভোটারসংখ্যা তিন লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ জন। রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ১৫৫ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১৪৮টিই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলটির রাজশাহীতে কাউন্সিলর পদে ১৬ জন ভোট করছেন। এ ছাড়া জামায়াতেরও কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন ৯ জন। এবার রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে মেয়র প্রার্থী চারজন। তারা হলেন : আওয়ামী লীগের এএইচএম খায়রুজ্জামান, জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম স্বপন, জাকের পার্টির একেএম আনোয়ার হোসেন ও ইসলামী আন্দোলনের মুরশিদ আলম। তবে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী দলীয় সিদ্ধান্তে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী একেএম আনোয়ার হোসেন বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সিলেট সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন আটজন। এ ছাড়া ৪২ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৭৩ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৮৭ জন নির্বাচন করছেন। সিলেট সিটি কর্পোরেশনে এবার ভোটার চার লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৩ জন। মোট ভোটারের ২০ শতাংশই প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন। তাই এই তরুণ ভোটাররা জয়-পরাজয়ে ফ্যাক্টর হতে পারেন বলে এলাকাবাসী মনে করছে। সিলেট সিটিতে ভোটকেন্দ্র ১৯০টি এবং ভোটকক্ষ এক হাজার ৩৬৪টি। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী আটজন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল, জাকের পার্টির মো. জহিরুল আলম এবং স্বতন্ত্র মো. আবদুল হানিফ কুটু, মো. শাহ জামান মিয়া, মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন ও মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা মাহমুদুল হাসান আগেই নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি মেয়র পদে নির্বাচন না করলেও কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছে দলটির ৪৩ স্থানীয় নেতা। এ ছাড়া জামায়াতেরও ২০ জন কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন বলে জানা গেছে। সিলেট সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নিজের বিজয়ে আশাবাদী জানিয়ে সাংবাদিকদের জানান, সিলেটের ভোটাররা খুব সচেতন। তারা বুঝেশুনেই ভোট দেন। কার পক্ষে নগরের উন্নয়ন করা সম্ভব, তা তারা বুঝতে পারছেন।
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা : রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার শেষ হয়েছে গত সোমবার। আজ বুধবার ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য পুরো রাজশাহী নগরীতে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে প্রশাসন। নির্বাচনের জন্যও প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটের উপকরণ পৌঁছানো হয়েছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে এবার ১৫৫ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে ১৪৮ কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এসব কেন্দ্রের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বাড়তি সতর্কতা থাকবে। রাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর তালিকা করা হয়েছে। আজ বুধবার রাজশাহী সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ১৫৫ ভোটকেন্দ্রে এক হাজার ১৫৩টি কক্ষে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হবে। নির্বাচনে এবার ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ৫২ হাজার ১৫৭ জন। পুরুষ ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৭১ হাজার ১৮৫ জন। আর নারী এক লাখ ৮০ হাজার ৯৭২ জন। ৩০ হাজার ১৫৭ নতুন ভোটার এবার ভোট দেবেন। রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আনিসুর রহমান বলেন, ভোটের দিন সব কেন্দ্রই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু কেন্দ্রের গুরুত্ব একটু বেশিই থাকে। এসব কেন্দ্রে ছয় থেকে সাতজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবেন।