বৈদেশিক ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে
—ড. জাহিদ হোসেন
অর্থনীতিবিদ
- ছয় বছরে বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ
- মার্চ শেষে স্থিতি ১০ লাখ ৪৩ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা
- বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার
বাজেট ঘাটতি মেটাতে গত কয়েক বছর ধরে বিদেশি দাতাগোষ্ঠী থেকে বিপুল ঋণ নিচ্ছে সরকার। ফলে বৈদেশিক ঋণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অর্থ বিভিন্ন খাতে ব্যয় হচ্ছে। এতে অর্থনীতির চাকা অনেক সচল হয়েছে। কিন্তু এ ঋণের সময়মতো সুদসহ কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ তৈরি করছে। অন্যদিকে দেশের রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে সর্বসাকুল্যে বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ বিলিয়ন ডলার। যা রিজার্ভের তিনগুণের বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত তিন বছরে বৈদেশিক উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েছে তিন হাজার ৩০০ কোটি ডলার। ২০২০ সালের মার্চ শেষে বৈদেশিক ঋণ ছিল ছয় হাজার ৩৬৩ কোটি ডলার। চলতি ২০২৩ সালের মার্চ শেষে এ অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৭১ কোটি ডলারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১০৯ টাকা হারে এর পরিমাণ ১০ লাখ ৪৩ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার বেশি। যা ২০২৩-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে বাড়ছে মাথাপিছু ঋণ। বর্তমানে যা ৫৬১ দশমিক ৮৮ ডলার। যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৩৬২ দশমিক ১০ ডলার।
অর্থাৎ তিন বছরে বেড়েছে ২০০ ডলার। একটি দেশের বৈদেশিক ঋণ বলতে বিদেশি ঋণদাতাদের, যেমন— অন্যান্য দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশি বেসরকারি সংস্থার কাছে দেশের পাওনার মোট অর্থকে বোঝায়। এটি সরকারি ও বেসরকারি উভয় ঋণের সমষ্টি। বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও প্রধান বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের মার্চের শেষ নাগাদ সরকারি খাত ৭৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে, যার মধ্যে ৬১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার সরাসরি সরকার ও বাকি অংশ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা ধার করা হয়েছে। এদিকে দেশের বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ মার্চ শেষে ২২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে ২৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২২ সালের মার্চে ২৫ বিলিয়ন ডলার ছিল। পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের বৈদেশিক ঋণ মাত্র ছয় বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। কারণ ২০১৬ সালে ৪১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে ৫১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮ সালে ৫৭ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলার ছিল।
অর্থনীতিবদরা বলছেন, বাহ্যিক দায় বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে, কারণ দেশের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ করা হবে। তারা টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং বিদেশি ঋণের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা এড়াতে দেশের সম্পদের যত্নসহকারে পরিচালনা এবং অগ্রাধিকার দেয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তারা বলেন, ক্রমাগত স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হওয়ায় সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, মোট বৈদেশিক ঋণ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হলো ঋণের সঠিক ব্যবহার এবং তার আউটপুট সর্বাধিক করা। তিনি সতর্ক করে বলেন, উৎপাদনশীল খাতে ঋণ কার্যকরভাবে ব্যবহার করা না হলে তা পরিশোধে অসুবিধা সৃষ্টি করবে, যা শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। আরেকটি সংকট হলো— রোল-ওভার লোন হিসেবে নতুন ঋণ প্রদানের অভাব, যার ফলে ঋণ গ্রহণ ও অর্থ প্রদানের প্রক্রিয়া জটিল হয়।
ড. জাহিদ উল্লেখ করেন, বিদেশি ঋণদাতারা আস্থার অভাব, অর্থ প্রদানে বিলম্ব এবং অনিয়মের কারণে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিতে দ্বিধাবোধ করছেন। সমস্যাযুক্ত পরিস্থিতি এড়াতে তিনি বৈদেশিক ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। তিনি আরও বলেন, যে আর্থিক অ্যাকাউন্টে ঘাটতি, চলতি হিসাবের সাথে বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ অব্যাহত রাখে। শেষ পর্যন্ত এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের হিসাবে ২০২৩ সালে বিদেশি ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধের জন্য ৯ হাজার ৩২২ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। ইআরডি তার প্রক্ষেপণে বলেছে, বিদেশি ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধের পরিমাণ ২০২৪ সালে আরও বেড়ে ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা হবে।
প্রসঙ্গত, বৈদেশিক বাণিজ্যে ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীনতা আন্তঃব্যাংক ডলারের হার বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসসহ মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে, দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ দশমিক ৮০ টাকা যা বর্তমানে বেড়ে ১০৮ টাকা হয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত ২১ জুন ৩০ দশমিক শূন্য এক বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। যা ২০২১ সালের আগস্টে রেকর্ড ৪৮ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। চলতি বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ের মধ্যে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। গত ১০ মাসে আমদানি পরিশোধ বাবদ খরচ হয়েছে ৫৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।