- ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ২৫০০ কিমি খোলা ড্রেন ও ৪ হাজার কিমি ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম আছে
ঢাকা শহরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ওয়াটার রিটেনশন এড়িয়া থাকা দরকার : ড. আদিল মুহাম্মদ খান
আমাদের কুইক রেসপন্স টিম দ্রুত ব্যবস্থা নেয় : সিইও, উত্তর সিটি কর্পোরেশন
রাজধানীর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫৫নং ওয়ার্ডের ফালুহাজী সড়কে থাকেন কুলসুম বেগম। দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করেন এ এলাকায়। ছোট মেয়ে সুখি হাজারীবাগের একটা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। গত মাসের ১৯ তারিখ হালকা বৃষ্টিতেই ডুবে যায় ফালুহাজী সড়ক। রাস্তা ছাড়িয়ে পানি ওঠে যায় ঘরের মধ্যেও। স্কুল বন্ধ থাকলে পড়াশোনা তো আর বন্ধ থাকে না। তাই মেয়েকে নিয়ে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে যাচ্ছিলেন কুলসুম। পানির মধ্যে হাঁটতে গিয়ে ছোট মেয়ে সুখির পা ড্রেনে পড়ে যায়। একটুর জন্য বেঁচে যায় এই ছোট্ট শিশু কিন্তু পায়ে ব্যথা পেয়ে এখন বাসায় বসে থাকতে হচ্ছে তাকে।
কয়েক দিনের তীব্র গরমে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল নগরবাসী। ঈদের দিন থেকে রাজধানীতে শুরু হয় টানা বৃষ্টি। এতে সড়কজুড়ে দেখা গেছে পানির ঢেউ। ফলে কর্মব্যস্ত মানুষের চলাচলে সৃষ্টি হয় অন্তহীন প্রতিবন্ধকতা। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। বৃষ্টির পানি ও তরল বর্জ্য নিষ্কাশনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনগুলো ঠিকমত সচল না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তরফ থেকে এ বছর জলাবদ্ধতা থাকবে না বলে আশ্বাস দিলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সরেজমিন দেখা গেছে, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ডুবে যায় রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকা। কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর পানি জমায় দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। অবৈধ খাল দখল, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পানি প্রবাহ ঠিক না থাকাকেই দায়ী করছেন তারা।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি সড়ক ও অলিগলিতে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধ সড়কে যানবাহনগুলো চলায় সৃষ্টি হচ্ছে ঢেউয়ের, আর সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে ফুটপাতে। পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, ধানমন্ডি, মিরপুর-১৩, ইস্কাটন, হাতিরঝিলের কিছু অংশ, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তায়, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, গুলশান লেকপাড় এলাকার সংযোগ সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সড়কে নেমে অফিসমুখী মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজে, পানি মাড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছেন। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে যানবাহনও বিকল হতে দেখা গেছে। বেশির ভাগ রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় শুষ্ক রাস্তায় সব গাড়ি ঢোকায় বিভিন্ন এলাকায় ছিল তীব্র যানজট। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মোট ২৫০০ কিলোমিটার খোলা ড্রেন এবং ৪০০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থাপনা করে আসছে। কিন্তু এতেও পুরোপুরিভাবে জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসী রক্ষা না পাওয়ায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ঢাকা উত্তর সিটির মিরপুর-১ নম্বরের সিটি কলোনিতে থাকেন জাহানারা বেগম। সামান্য বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় তাদের পুরো কলোনি। অনেক সময় ড্রেন দিয়ে চলে আসে ময়লা পানি। যার কারণে ঘরেও থাকতে পারেন না তারা। ছোট ছোট বাচ্চা ও বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে অসহায় তারা। বারবার অভিযোগ করেও সমাধান পাননি এই ভুক্তভোগীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময় ঢাকা মহানগরীতে প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে এবং প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স-কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আসছিল। কিন্তু গত ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
জলাবদ্ধ সড়কে রিকশায় গুলশান দিয়ে যাচ্ছিলেন চাকরিজীবী আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, অফিসের কাজে বাইরে বের হয়ে বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতার কবলে পড়লাম। যানবাহন যাওয়ার সময় জমে থাকা জল ঢেউয়ের মতো গায়ে এসে পড়ছে। আমার জামা কাপড় নষ্ট হয়ে গেল। এই অল্প বৃষ্টিতেই যদি এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় তাহলে আসন্ন বর্ষায় কেমন ভোগান্তি হতে পারে বুঝা বড় কষ্টকর। তিনি বলেন, এমন বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা যেন রাজধানীতে না হয় সে ব্যবস্থা নেয়া উচিত সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়ক, ধানমন্ডির সড়কে একই রকমের জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে মেরুল বাড্ডার ডিআইটি সড়ক, লিংক রোড সংলগ্ন আদর্শ নগরের সড়ক জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়াও পান্থপথ, নিউমার্কেট, শুক্রাবাদ, মিরপুর সড়ক, ধানমন্ডি, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকার কিছু কিছু সড়কে বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতার খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নুরে আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত বৈঠকে আমাদের সমস্যাগুলো মেয়র মহোদয়কে জানাই, তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। আসলে কিছু কিছু এলাকায় পানি জমার কারণ হচ্ছে বের হওয়ার জায়গা না থাকা। অনেক বাড়ির মালিক এই পথগুলো বন্ধ করে দেয়। আমরা চেষ্টা করছি সমস্যা সমাধানের।’
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান আমার সংবাদকে বলেন, এটি আসলে নগর পরিকল্পনার বিষয়, সেই সাথে জলাশয়গুলো সংরক্ষণের বিষয়। এ দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষাকালের তিনমাস তো খুব বৃষ্টি হয়। এদেশের নগর পরিকল্পনা করতে গেলে অবশ্যই পয়ঃনিষ্কাশনের জায়গাগুলোর পরিকল্পনার দরকার ছিল। আমাদের ঢাকা শহরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ওয়াটার রিটেনশন এড়িয়া যেটা বৃষ্টির পানি ধারণ করবে। আবার যেসব এলাকায় উন্নয়নকাজ হবে সেখানেও যেন আমাদের অনাচ্ছাদিত এলাকা থাকে, যাতে যেখানে বৃষ্টির পানি পড়বে তা যেন ২০ থেকে ৩০ ভাগ মাটির নিচে চলে যেতে পারে। এই জিনিসটা দরকার ছিল প্লান করে করার কিন্তু সেটা করা হয়নি। তাছাড়া আমাদের নিজস্ব যে জলাশয়গুলো ছিল তাও আমরা ধ্বংস করেছি। রাজধানীর আশপাশে যে খাল-বিল বা জলাশয় ছিল তাও দিনের পর দিন ভড়াট হয়েছে। আমাদের নগর পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে আমাদের ভূপৃষ্ঠের পানি যে নিচের দিকে অর্থাৎ মাটির নিচে যাবে তার কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। আমাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থাও পরিকল্পিত না, যার কারণে অল্প বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তিনি আরও বলেন, বাজেটের আগে দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে এমন ভাবনায় বর্ষাকাল এলে ঢাকায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয় এটাও দুর্ভোগের অন্যতম একটা কারণ। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা আমার সংবাদকে বলেন, এ অবস্থা আগের থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে। তারপরও আমাদের এলাকায় যদি কোথাও পানি জমে আছে এমন খবর পাওয়া যায় তবে আমাদের কুইক রেসপন্স টিম সেখানে গিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।
তিনি আরও বলেন, ড্রেনের কাজগুলো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হয়েছে যার ফলে কোথাও কোথাও উঁচু নিচু রয়েছে। এ কারণেই কিছু কিছু জায়গায় পানি জমে থাকতে পারে কিন্তু সেটা খুবই অল্প সময়ের জন্য। এটাকে আসলে জলাবদ্ধতা বলা যাবে না। জলাবদ্ধতার জন্য যে সব জায়গায় সমস্যা ছিল অর্থাৎ কালভার্টগুলো কিন্তু অপসারণ করা হয়েছে। কোথাও সমস্যার খবর পেলে আমরা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করি।