৬০-৭০ আসনে জিতে আসতে পারবে বলে দলীয় ভাষ্য
- দলীয় সরকার ছাড়া যে প্রক্রিয়ায় ভোট হয়, তাতে লড়বে দলটি
- ২৭ শতাংশ ভোট রয়েছে— দলীয় জরিপের প্রতিবেদন
- এককভাবে লড়াই ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিচ্ছে জামায়াত
- চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও রাজশাহীতে সমাবেশের পর ঢাকায় চূড়ান্ত বার্তা
এবার কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠায় দুর্বার আন্দোলন
—অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
ভারপ্রাপ্ত আমির
২০২৩ সাল আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচনের বছর
—মাওলানা আবদুল হালিম
সহ-সেক্রেটারি জেনারেল
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৬০ আসনে জামায়াত এককভাবে নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত প্রার্থী ঠিক করেছে। তবে এই সংখ্যা থেকেও আরও কিছু আসন কমতে পারে। শেষ সময়ে এসে সেই সংখ্যা ১৪০-১৪৫ আসনেও নেমে আসতে পারে। অবশ্য এখন পর্যন্ত ১৬০ আসনই চূড়ান্ত রয়েছে। যদিও নির্বাচনি প্রচারণা রয়েছে ৩০০ আসনে। জামায়াত মনে করছে, এককভাবে নির্বাচন করলে ৬০-৭০টি আসনে তারা জিতে আসতে পারবে। তারা নিজস্ব জরিপ চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছে দেশের ভোটারের ২৭ শতাংশ ভোট জামায়াতের রয়েছে। গত ১৫ বছর ও দলের প্রথম সারির নেতাদের ফাঁসির পর দলটিতে ১০ শতাংশেরও বেশি ভোট বেড়েছে বলে তাদের জরিপে রয়েছে।
এছাড়া গত ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় চার কোটি তরুণ ভোটার ভোট প্রয়োগ করতে পারেননি। যার অধিকাংশ ভোটই এ দলটির পক্ষে যাবে। জামায়াত নিয়ে দু’দলের টানাটানিতে এখন তারা এককভাবে নির্বাচনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে রয়েছে। খুব শিগগিরই বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে ভোট প্রচারের মহড়া দেবে দলটি। তবে তারা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো ভোটে যাবে না। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে ছাড়া যে প্রক্রিয়ায় ভোট হয়, তাতেই লড়বে দলটি। এছাড়া বিএনপির শীর্ষ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আটকের পর আন্দোলনে ব্যর্থতা এবং তার বন্দি অবস্থায় জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানোয় বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনে থাকাও বিপজ্জনক মনে করছে দলটি। জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার দুই সদস্য আমার সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সরকারের সঙ্গে পর্দার আড়ালে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি মিটিং হয়েছে। সর্বশেষ গত মাসে এক বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে একটি আপস প্রস্তাব দেয়া হয় জামায়াতকে। জামায়াতে ইসলামী সেটি গ্রহণ করলে তৃণমূলে ভাঙন তৈরি হতে পারে বলে দলীয় ফোরামে পর্যবেক্ষণ এসেছে। রাজনীতি এবং ইসলামী আদর্শ— এ দুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ তৈরি হতে পারে। তাই এখনই তারা সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাচ্ছে না। যদিও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামী সরকারের সঙ্গে বসে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব’ নীতি গ্রহণ করে বলেও রাজনীতির মাঠে কথা রয়েছে। তবে সেটি তিন বছরের বেশি যায়নি। দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানকে গ্রেপ্তারের পর সেই নীতিও ভঙ্গ হয়। এছাড়া দলটির একাংশের দাবি, সরকার বিএনপির বিকল্প তৈরিতে জামায়াতকে ভোটে নিতে নেতাদের আটক করেছে। কিন্তু শীর্ষ নেতারা সেখানেও মাথানত করেননি। বরং তারা আদর্শের পরিচয় দিয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির পর খুব সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে জামায়াত। আগামী ২৩ জুলাই মার্কিন দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হবে। এবার প্রথমবারের মতো ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমানসহ তিনজন আমন্ত্রণ পেয়েছেন সে অনুষ্ঠানে। এছাড়া গত ১০ জুন ঢাকায় সমাবেশের পর এখন ফুরফুরে রয়েছে দলটি। আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ্যে বিভাগীয় সমাবেশ শুরু করতে যাচ্ছে দলটি। চট্টগ্রাম থেকে সেই সমাবেশ শুরু হবে। এ নিয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ আমার সংবাদকে বলেন, বিভাগীয় সমাবেশ করার বিষয়ে জামায়াতের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল নেতাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথমদিকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও রাজশাহীতে সমাবেশ করার কথা ভাবা হচ্ছে। আমাদের সমাবেশ শন্তিপূর্ণ হবে। আশা করি প্রশাসন সমাবেশের অনুমতি দেবে। আমাদের সমাবেশ যে শান্তিপূর্ণ হয়, গত ১০ জুন তা প্রমাণিত হয়েছে। আগামীর সমাবেশগুলোতেও শৃঙ্খলার নজির রাখবে জামায়াত।
জামায়াত নিয়ে এখন বড় দুদলেই আলোচনা বাড়ছে। সবাই জামায়াতকে নিজেদের ঘরে টানতে চাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব চলছে। তখন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যাওয়া নির্বাচনে জামায়াতকে ঘোষিত ২৪টি আসনে ধানের শিষ প্রতীক দেয়া হয়। আর ঐক্যফ্রন্টের জোটকে দেয়া হয় ২৩টি আসন। ভরাডুবির পর দেশের সিংহভাগের সন্দেহ ছিল ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুলের ষড়যন্ত্রে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ভরাডুবির ছক পূর্বনির্ধারিত ছিল। এছাড়া জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পর বিএনপি থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া হয় সরকার পতনে ১০ দফা। একাত্মতা প্রকাশ করে জামায়াতও একই কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু প্রথম কর্মসূচিতে মালিবাগে জামায়াতের ওপর হামলা ও আটকের ঘটনা ঘটে। প্রতিবাদে জামায়াত বিএনপি থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আবারও ‘একলা চলো’ নীতিতে চলে যায়। কিন্তু জামায়াত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আবারও আলোচনার মধ্যে চলে এসেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল গত শুক্রবার ঠাকুরগাঁওয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘মুখে মুখে জামায়াতবিরোধিতার ধুয়া তুললেও সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট’। এর এক দিন পর মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের পালটা জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামী বিএনপির ‘বি টিম’, এটা দেশের সচেতন মানুষ সবাই জানে।’ তবে এ ব্যাপারে কড়া জবাব দিয়েছে জামায়াত। তাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম জানান, ‘বর্তমান স্বৈরশাসকের’ বিরুদ্ধেও জামায়াত নিয়মতান্ত্রিভাবে রাজপথে আন্দোলন করে যাচ্ছে। গত ১৫ বছরে জামায়াত সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত এবং মজলুম। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়ার পর বর্তমান আমিরে জামায়াত, নায়েবে আমির, সেক্রেটারি জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদেরও কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী কোনো ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার ও জালেমের সঙ্গে আঁতাত, সমঝোতা বা যোগাযোগ করে কখনো রাজনীতি করে না। করার প্রশ্নই আসে না। কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা ও একদফার আন্দোলনের জন্য গোটা জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ, তখন এ-জাতীয় বক্তব্য সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমরা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি এবং সরকারবিরোধী এক দফা আন্দোলন জোরদার করার জন্য সব বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। জামায়াতে ইসলামীর সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর স্থায়ী কমিটির একটি অংশ এবং দলটিতে যারা বাম আদর্শে বিশ্বাসী, তারা জামায়াতে ইসলামীকে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। তারা এও মনে করছে, শুধু জামায়াত নয়, বিএনপির একটি অংশ খালেদা জিয়াকেও নেতৃত্ব থেকে মাইনাসের ষড়যন্ত্র করছে। এ পরিস্থিতিতে তারা বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনে থাকাও বিপজ্জনক বলে মনে করছে। তাই এবার তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে এককভাবে ভোটের মাঠে থাকতে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়েছে। দলটি মনে করছে, জামায়াতের আদর্শের কোনো ভোট ভিন্ন প্রতীকে যাবে না। এছাড়া তারুণ্যের ভোটও জামায়াত ব্যাংকে পড়বে।
জামায়াতের তরুণ নেতা শাফিউল আলম বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের প্রায় চার কোটিরও বেশি নতুন ভোটার ভোট প্রয়োগ করতে পারেনি। আমরা মনে করছি, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা, ক্যাম্পাসসমূহকে শিক্ষিত জাতি গঠনের পরিবর্তে দলীয় কর্মী তৈরির কারখানায় পরিণত করাসহ সামগ্রিক বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের ওপর তরুণ সমাজ বিব্রত, বিরক্ত; এমনকি বিরোধী আরও কিছু রাজনৈতিক দলের আদর্শে অস্পষ্টতা ও দ্বিমুখিতা নিয়ে অনেক তরুণের মনে অসন্তোষ রয়েছে। এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী সচেতন তরুণদের মাঝে একটি সুস্পষ্ট আদর্শ উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে এবং শৃঙ্খলিত নেতৃত্বে জুলুম-নির্যাতনেও আদর্শচ্যুত না হওয়ায় তরুণ প্রজন্মের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে। তাই আমরা মনে করি, ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্মের ভোট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষেই যাবে।
সম্প্রতি দলটির এক কর্মিসম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দলনিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জামায়াতকর্মীদের দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং গণআন্দোলনের মুখে এ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে। এ নিয়ে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ২০২৩ সাল হলো আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচনের বছর। কেয়ারটেকার সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজপথ ছাড়বে না।