ঝড়ে পড়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনক
- ৫ বছরে কমেছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ
- মাউশি শিক্ষার্থী কমার বিষয়টি জানে না
- বিশেষজ্ঞরা বলছেন— আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত, কোভিড ও বাল্যবিবাহইএর মূল কারণ
মিড ডে মিল চালু, বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনা ও শিক্ষণ ঘাটতি দূর করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে
—অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান
সাবেক পরিচালক, আইইআর, ঢাবি
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে
—ড. তারিক আহসান
অধ্যাপক, ঢাবি
প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে এসে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। গত পাঁচ বছর ধরে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। গড়ে প্রতি বছর ৬৮ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। অথচ এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিষয়টি জানেন না মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞরা শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার এ হারকে আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, অভিভাবকরা এখন আর শিক্ষাকে লাভজনক মনে করছেন না। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার নেপথ্যে কোভিডকালীন হতাশা আর বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। তবে ঝরে পড়ার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে সরকারিভাবে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
ব্যানবেইসের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী সংখ্যা এক কোটি এক লাখ ৩৩ হাজার ১৪৩ জন। যদিও ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর চাইতেও প্রায় সাড়ে তিন লাখেরও বেশি ছিল। ২০১৮ সালে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল এক কোটি চার লাখ ৭৫ হাজার ১০০ জন। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী সংখ্যা কমতে থাকে। ২০১৯ সালে পূর্বের বছরের চেয়ে এক লাখেরও বেশি কমে হয়েছে এক কোটি তিন লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন। ২০২০ সালেও এক লাখের কাছাকাছি শিক্ষার্থী কমেছে। এই বছর মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিল এক কোটি দুই লাখ ৫২ হাজার ১২৬ জন। কমার ধারাবহিকতার প্রভাব ছিল ২০২১ সালেও। করোনার সময় ৬০ হাজারের অধিক কমে হয়েছে এক কোটি এক লাখ ৯০ হাজার ২২ জন।
মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী কমার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটা সময় মানুষ পড়াশোনাকে জীবনধারণের হাতিয়ার হিসেবে মনে করত। যার ফলে তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য দিয়েছেন। কিন্তু এখন আর তারা সেটি মনে করছেন না। তারা পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজ শেখাচ্ছেন। আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে অনেক পরিবার পড়াশোনা করানোকে লাভজনক মনে করছেন না। কৃষি বা অন্য কাজ করলে দিন শেষে তারা ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা বাবা-মায়ের হাতে দিচ্ছে। মুখস্থ-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় অভিভাবকরা আর আস্থা পাচ্ছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোভিডকালীন বাস্তবতা। এই সময়ে পরিবারগুলো আরও বেশি হতাশ হয়েছে। বর্তমানে বাল্য বিবাহের হার অনেক বেশি বেড়ে যাওয়াও শিক্ষার্থী কমার অন্যতম কারণ।
মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী কমার বিষয়টি জানেন না মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ( মাউশি) কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে মাউশির (মাধ্যমিক উইং) পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষার্থী কমার বিষয়টি আমরা জানি না। তবে আমরা যতদূর জানি মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে এমনটা কেন এসেছে আমরা জানি না।’
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) স্পেশালিস্ট (পরিসংখ্যান) এস এম কামরুল হাসান খান আমার সংবাদকে বলেন, প্রত্যেক বছরের অক্টোবর মাসে আমরা অনলাইনে মাধ্যমে দেশের সব প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। এরপর বিভিন্নভাবে আমরা ডাটার সত্যতা যাচাই করি। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানকেই ব্যানবেইসের ইআইএন নাম্বার দেয়া আছে। তথ্য না দেয়ার সুযোগ নেই।
শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. তারিক আহসান বলেন, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পাঠে ফেরানোর জন্য আগ্রহীকরণে এনসিটিবি, মাউশি ও ডিপিইর সমন্বয়ে একটা কমিটি গঠন করতে হবে। এনসিটিবি নীতি নির্ধারণ করবে। আর মাউশি ও ডিপিই সেটি বাস্তবায়ন করবে। আমাদের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের গতানুগতিকভাবে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না। পড়াশোনা বাদে তারা কী করছে? সেটি দেখতে হবে। সেই কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার্থীদের ফেরানোর কথা ভাবতে হবে। তবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করেন শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের এই অধ্যাপক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ বের করার জন্য সরকারিভাবে গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণায় পাওয়া কারণগুলোর আলোকে সমাধান খুঁজতে হবে। একজন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট হিসেবে আমার পরামর্শ থাকবে, মাধ্যমিকে আমরা মিড ডে টিফিনটা চালু করতে পারি। বাল্য বিবাহ বন্ধ করার জন্য স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি ও মহল্লার মোড়ল-মাতুব্বরদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মসজিদের ইমামদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে। ঝরে পড়াদের ফিরিয়ে আনার জন্য এখনই কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাদের শিখন ঘাটতি দূর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাছাইকৃত শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।