- বর্ষাকাল ও এইচএসসি পরীক্ষায় আন্দোলন ব্যাঘাতের শঙ্কা
- এবারের আন্দোলনও ঐক্যফ্রন্টের ফটোকপি বলে ভাষ্য
- চলতি মাসেই একদফা ও তত্ত্বাবধায়কের রূপরেখা
- হাইকমান্ডের বিদেশমুখিতায় তৃণমূলে ক্ষোভ বাড়ছে
ঈদের পর আন্দোলন— এমন ঘোষণার পর ১৮টি ঈদ পালন করল বিএনপি। ২০১৪ সালে একটি ইফতার মাহফিলে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ঈদের পর আন্দোলন করবে দলটি। পুলিশ বাহিনী কিংবা সরকারি দলের নেতারা যদি অস্ত্র দিয়েও বাধা দেয় তার পাল্টা জবাব দেয়া হবে। এবারও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রোজার ঈদ ও কুরবানির ঈদের পর বড় আন্দোলনের ঘোষণা ছিল। তত্ত্বাবধায়ক দাবি মেনে সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করা হবে। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, আলোচনায়ও বসা হবে না। দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৮তম ঈদই শেষ ঈদ। এখন ঈদ শেষে দলটির হাইকমান্ড বলছে, চলতি জুলাই মাসে আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপরেখা দেয়া হবে। মধ্য জুলাইয়ে বিএনপির সঙ্গে সমমনা দলগুলো নিয়ে সরকারের পতনের একদফা ঘোষণা করা হবে। ঐক্যফ্রন্টের মতো এবারও কিছু ঘরোয়া জটিলতা চলছে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে। আন্দোলন কী এক মঞ্চে হবে নাকি আলাদা মঞ্চে হবে। সেগুলো চলতি সপ্তাহে সমাধান করা হবে। এ নিয়ে চলছে গুলশানে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে সিরিজ বৈঠক। এছাড়া জুলাইয়ের শেষ সময়ে ঘোষণা দেয়া হবে নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার খসড়া। ৯০ ও ৯৬ সালের আদলেই তা তৈরি করা হচ্ছে। কারা থাকবে কারা থাকবে না তা যুক্ততেই শেষ সময় পার করছেন। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে চূড়ান্ত খসড়া সামনে নিয়ে আসা হবে। এছাড়া কূটনৈতিক তৎপরতার ফসল ঘরে তুলতেও ব্যস্ত বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে এবারও বিএনপির আন্দোলনে রয়েছে বাধা। বিএনপির আন্দোলনের ঘোষণার মধ্যে চলছে বর্ষাকাল। ঢাকায় একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। এই সময় প্রায় টানা বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বৃষ্টির দিনে রাজপথে কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন অবশ্যই দুরূহ হবে। এছাড়া বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর দেশব্যাপী শুরু হবে এইচএসসি পরীক্ষা। এর কিছুদিন পরই অক্টোবরের শেষ দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। বৃষ্টি ও পরীক্ষার সময় পর্যন্ত আন্দোলন টেনে আনা সফলতার জন্য বিপজ্জনক বলেও মনে করা হচ্ছে। তবে তৃণমূল নেতারা বলছেন, দ্বাদশ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি। ঢাকামুখী আন্দোলন করে এখনই ঘরে ফসল উঠানোর সময়। খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। গেল নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপির ভরাডুবির পর দলটি বহু বছর পিছিয়ে পড়ে। এবারও অতীতের সব ব্যর্থতা ও গ্লানি মুছে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এজন্য দলের হাইকমান্ডকে সরকার হটানোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে হবে। তবে আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, আন্দোলনের জন্য সরকার বিএনপিকে উসকানি দিচ্ছে, সরকার চায় বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও করুক কিন্তু বিএনপি সেটি বুঝতে পেরেছে। তাই জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে যাবে না। এবার তারা যে এক দফার আন্দোলন ঘোষণা দিচ্ছেন সেখানে হরতাল কিংবা অবরোধের মতো বড় কর্মসূচিও নেই। সমাবেশ অবস্থান কর্মসূচির মতো নরম কর্মসূচি রয়েছে।
এদিকে বিএনপির হাইকমান্ড একেবারেই বিদেশমুখিতা হয়ে গেছে। বিএনপির কেউ মনে করছেন বিদেশিদের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। মির্জা ফখরুল তখন সাংবাদিকদের জানান, আমরা স্পষ্ট বলে এসেছি এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। জানা গেছে, এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। এ ছাড়া আগামী সপ্তাহে সফরে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনি পর্যবেক্ষণে অগ্রবর্তী দল। এই দলের রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেবে ইইউ। তাদের এই সফরের আগে। বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকায় তৃণমূল নেতাদের অনেকেই বিএনপির ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ফেনী জেলার ইসমাইল হোসেন নামের মাঠপর্যায়ের এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের কাদের, তোফায়েল, আমু, মতিয়া, মজিবুল হক, মহিউদ্দিন আলমগীর, মায়ার মতো রাজপথে নির্যাতন সহ্য করার শক্তি বিএনপির খুব কম নেতারই আছে। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন ও আন্দোলনের কথা এলে ত্যাগ, নির্যাতন, নেতৃত্ব এগুলোও মাথায় রাখতে হয়; সে ক্ষেত্রে তো আওয়ামী লীগই এগিয়ে। আমাদের বিএনপির নেতৃত্বে লোভ ও দুর্বলতা রয়েছে। কৌশল বলে বলে দূরে আছি। খালেদা জিয়ার জন্যও কিছু করা সম্ভব হয়নি। এখন আমরা তাকিয়ে আছি বিদেশিদের দিকে। এটা হাইকমান্ডের ব্যর্থতা। তৃণমূলের কাছে অবশ্যই তাদের জবাব দিতে হবে।
ঢাকার শীর্ষ একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমার সংবাদকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে বেশ কবার কঠোর আন্দোলনের পদক্ষেপ নিয়েও শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি দলটি। বিশেষ করে ওই বছর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পর বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়। মনে রাখা দরকার, কই মাছ সবসময় শুকনো মাটি পাড়ি দেয় না। একটা মৌসুম সময় থাকে। আন্দোলন করার জন্য বিএনপি শত শত ইস্যু পেয়েছে তার একটিও কাজে লাগাতে পারেনি। এখন ইস্যু ছাড়া ঘোষণা দিয়ে সরকারকে সরিয়ে ফেলবে, এটা সূত্র ছাড়া অঙ্কের সমাধান খোঁজা মাত্র। এবার বিএনপির সামনে যথাযথ সুযোগ রয়েছে। কাজে লাগাতে না পারলে দলটি দীর্ঘায়িতভাবে দূরে সরে যাবে।
বিএনপি সমমনা জোটের শীর্ষ একটি দলের প্রধান আমার সংবাদকে বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এখন যে আন্দোলনের পথে হাঁটছে আমার কাছে তা ঐক্যফ্রন্টের ফটোকপি মনে হচ্ছে। ২০১৮ সালের মতো আরও খারাপ অবস্থা হতে পারে বলেও আমার কাছে মনে হচ্ছে।’ জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান রহমান আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক চলছে। গত বুধবার জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। গতকাল ১২ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক হয়। গণতন্ত্র মঞ্চ, এলডিপিসহ অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক হবে। বৈঠক শেষে চলতি মাসেই একদফার ঘোষণা দেয়া হবে। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে, শীঘ্রই তা ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, আন্দোলন কখনো বলে কয়ে আসে না। এবার সরকারের পতনের আন্দোলন কবে সফল হবে এমন প্রশ্ন ঠিক নয়।