কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপে অর্জন কতটুকু

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২৩, ১২:৪৯ এএম
কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপে অর্জন কতটুকু
  • ঢাকায় ইইউর ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলের মিশন শুরু 
  • মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি আসছেন ১১ জুলাই 
  • ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন পিটার ডি হাস

জনগণের আন্দোলন ছাড়া পরিবর্তন আসে না 
—ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি

অভ্যন্তরীণ সংকট সমাধানে রাজনৈতিক অনুঘটকদেরই মূল রোলটি প্লে করতে হয় 
—ড. সাব্বির আহমেদ
অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি

নিজস্ব সিস্টেম কাজ না করলে বিদেশিরা নাক গলান 
—মুহাম্মদ রুহুল আমিন
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি  

অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। বাংলাদেশের সচেতন মহলে একটি পরিচিত নাম। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট যখন তীব্র তখন তিনি বিরোধীয় উভয় পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিবের দায়িত্বে থাকা এ তারানকো এ প্রচেষ্টা চালান সংস্থাটির পক্ষ থেকে। ২০০৫ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের সময় তিনি বেশ দৌড়ঝাপ করেন। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের নামও মানুষের কাছে অতি পরিচিতি পায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এক বছর অপেক্ষা করে বিএনপি-জামায়াত আন্দোলন শুরু করলে ফের তৎপরতা শুরু করে জাতিসংঘ। আবারও আসেন অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালও তৎপরতা চালান সংকট সমাধানে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই সময়ের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। 

আর কয়েক মাস পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনের আগে বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে সরকার পতনের একদফার আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো রাজপথে রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে অতীতের মতো বিদেশি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের দৌড়ঝাঁপ বাড়ছে। কিন্তু এতে সংকট কি সমাধান হবে- এমন প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশর অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো সমাধানে বিদেশিদের তৎপরতায় সুফল আসে না। দেশে পরিবর্তন বা নতুনত্ব আসে জনগণের আন্দোলনে। অভ্যন্তরীণ সংকটের স্থায়ী সমাধান চাইলে দেশের রাজনীতিতে যারা অনুঘটক এ বিষয়ে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া বাংলাদেশ সফরে আসছেন ১১ জুলাই। বাংলাদেশের নির্বাচনি পরিবেশ এবং নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছয় সদস্যের একটি অনুসন্ধানী দল ঢাকায় এসেছে। গতকাল শনিবার ইইউর ছয় সদস্যের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দলের দুজন সদস্য ঢাকায় পৌঁছেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময় বাকি চারজন ঢাকাগামী বিমানে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশন প্রধানের দপ্তর গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। আজ রোববার থেকে ইইউ টিমের দুই সপ্তাহব্যাপী ঢাকা মিশন শুরু হবে। মিশনের মূল কাজ হবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পরিবেশ আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক টিম পাঠালে তার কর্মপরিধি কী হবে, বাজেট, লজিস্টিক ও নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় নির্বাচন কমিশন কতটা ফ্যাসিলেটেড করবে তার আগাম মূল্যায়ন করা। দেশে অবস্থানকালে প্রতিনিধি দলটি সরকারের প্রতিনিধি, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করবে।

এদিকে, আগামী ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া বাংলাদেশ সফরে এসে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটসহ মানবিক, শ্রম, মানবাধিকার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানবপাচার ইস্যুতে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলবেন বলে জানা গেছে।  ঢাকা সফরের আগে উজরা জেয়া ভারত পৌঁছাবেন। সেখানে তিনি মার্কিন-ভারত অংশীদারিত্বকে আরও গভীর এবং স্থায়ী করার বিষয়ে আলোচনা করতে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করবেন। আলোচনায় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সমাধান, গণতন্ত্র, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও মানবিক সহযোগিতার বিষয়গুলো উঠে আসবে। অবশ্য ৬ জুলাই পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, উজরা জেয়া সফর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বচানকেন্দ্রিক নয়। 

এ ছাড়া গত ৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় আসার পর এদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেড় ঘণ্টা কাটান তিনি। বৈঠক করেছেন দুই দফায়। সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই দিন বেলা ১১টার দিকে যান পিটার হাস। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রায় ৪০ মিনিট বৈঠক চলে। এরপর তিনি বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক-বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সাথে। দ্বিতীয় বৈঠকটি চলে পৌনে এক ঘণ্টা; বেলা ১১টা ৪২ থেকে ১২টা ২৮ মিনিট পর্যন্ত। বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলেও সেখানে কী কী বিষয় আলোচিত হয়েছে, তা কোনো পক্ষ থেকেই জানা যায়নি। এ নিয়ে উভয় পক্ষই নীরব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সবসময়ই বিদেশিরা তৎপরতা চালায়। এটি নতুন কিছু নয়। বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোর আগেও এ ধরনের তৎপরতা শুরু হয়েছিল। এর কারণ আছে। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতি বিভাজন আছে, বড় ধরনের বিভাজন— আর এ বিভাজনের কারণে বিদেশিদের সুযোগ তৈরি হয়। আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলপাকালে তিনি বলেন, রাজনীতিতে বিভাজনের কারণে যারা অপজিশনে থাকেন তারাও বিদেশিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেন। সে হিসেবে বিদেশিরা সুযোগ পান। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে বিভাজনটি থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এ অবস্থা থেকে বের হতে পারব না। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা কখনোই দেখিনি যে, বিদেশিরা এসে আমাদের সমস্যা সমাধান করেছেন। আমরা ইতিহাসে দেখি, পরিবর্তনটা তখন হয়, যখন লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামে, আন্দোলন হয়— আন্দোলনে ত্যাগ স্বীকার হয় (প্রাণহানি ঘটে, যেটি কাম্য নয়), অর্থাৎ জনগণের আন্দোলনের কারণেই বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। এখন বিষয়টি হচ্ছে, বিদেশিদের একটি আগ্রহ আছে এবং থাকে, কারণ এখানে তারা অনেক বিনিয়োগ করেছে। বিদেশিদের বিনিযোগ থাকার কারণে তারা আগ্রহ দেখায়। এখন শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে দেশের জনগণ কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়। জনগণের পদক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশে পরিবর্তন এসেছে বা নতুনত্ব এসেছে এমনটি দেখা যায়নি। 

‘গরিবের বউকে সবাই ভাবি ডাকে না? বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ সংকটের সময় বিদেশিদের তৎপরতা ঠিক এমন। যদি কোনো দেশের নিজস্ব সিস্টেম কাজ না করে তখন বাইরের দেশের লোকেরা নাক গলায় বেশি।’ এসব মন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর মুহাম্মদ রুহুল আমিনের। দৈনিক আমার সংবাদের সাথে আলাপকালে তিনি এমন মন্তব্য করেন। 

তিনি বলেন, যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাদের দলের নেতারা স্বেচ্ছাচারিতা করেন। গুড গভর্ন্যান্স থাকে না, গণতন্ত্র থাকে না, যার ফলে বিদেশিরা নাক গলান। কারণ, তারা দাতা দেশ, উন্নয়ন সহযোগী, আর এসব কিছু মিলিয়ে তারা একটু বেশি খবরদারি করেন। এটি যেকোনো দেশের জন্য ভালো নয়। অনেকটা ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’। এটি না হলে খুব ভালো হয়। এখন মুশকিল হলো— যেমন আমাদের দেশে গত কয়েকটি নির্বাচন হলো, ঠিকমতো হলো না, গুম-খুনের কত রিপোর্ট পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। এসব কিছু মিলিয়ে বিদেশিরা ঢুকে পড়েন। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে বিদেশিদের ঢুকে পড়া কতটা সফল বা ব্যর্থ তা নির্ভর করে আমরা কিভাবে রেসপেক্ট করি, যেমন— ‘রোম যখন জ্বলছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ এখন যারা সরকারি ও বিরোধী দলে আছেন, মনে হচ্ছে তারা বাঁশি বাজাচ্ছেন। তারা সমস্যা গভীরতাটা বুঝতে চাচ্ছেন না। বিদেশিরা যখন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন, তখন আমাদের উচিত তাদের সঙ্গে কো-অপারেট করা। যেমন আমেরিকার ভিসানীতি— এতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি, কারো টেনশনের কোনো কারণ নেই। তারা যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে এবং এতে যেসব কন্ডিশন দেয়া হয়েছে তা পূরণ করলেই তো হয়েছে যায়। কিন্তু সমস্যা আমাদের নিজেদের, আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক নই। প্রফেসর মুহাম্মদ রুহুল আমিন আরও বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ দেশের জন্য কোনোভাবেই ভালো নয়, তবে তারা যখন ইতিবাচক বিষয়ে তৎপর হন তখন বিষয়গুলো পজিটিভলি নিলেই ভালো হয়, বিদেশনীতির ক্ষেত্রে আমাদের জতীয় ঐক্য দরকার। যেমন মালয়েশিয়া, তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ও বিদেশনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে, ফলে সেখানে বিদেশিরা গিয়ে নাক গলাতে পারেন না। যেমন এখন আমেরিকা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তৎপর, এখন আমাদের উচিত তাদের সঙ্গে কো-অপারেট করা, কিন্তু অবশ্যই সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে বলেন, ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের যত সংকট তৈরি হয়েছিল বিদেশিরা এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের চেষ্টায় কোনো কাজ হয়নি। যেমন ধরুন জাতিসংঘের দূতের মধ্যস্থতা, কমলওয়েলথ দূতের মধ্যস্থতা হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। দেশের অভ্যন্তরে কোনো সংকট তৈরি হলে দেশের রাজনৈতিক অনুঘটকদেরই মূল রোলটি প্লে করতে হয়। বিদেশিরা চাপ প্রয়োগ করে হয়তো একটি নির্বাচন করাবে, তাকে সমস্যার সমাধান হবে  না। দেশের অভ্যন্তরীণ ভালো-মন্দ বুঝতে হবে। বিশেষ আওয়ামী লীগকে আগে বুঝতে হবে, পরে বিএনপিকেও বুঝতে হবে। অন্য দলগুলোকেও বুঝতে হবে। নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে, বাইরের লোকেরা এসে যে তৎপরতা চালান তাতে হয়তো সমস্যা থেকে সাময়িক উত্তরণ ঘটবে, তবে স্থায়ী সমাধান হবে না।