২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি খাত
- এক বছরে নিয়েছে এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা
- লক্ষ্য অতিক্রম করে শেষ মাসে ঋণের রেকর্ড
- নতুন নোট ছাপিয়ে ৭৮ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক
সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ব্যাংকনির্ভর ঘাটতি বাজেট তৈরি করে ভীতি ছড়িয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেই ভয় আরও বাড়িয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে লক্ষ্যের চেয়েও অনেক বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। ব্যাংক ঋণের এ অঙ্ক অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণের চাপ সইতে না পারায় টাকা ছাপিয়ে সরকারের চাহিদা পূরণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা অর্থনীতিতে নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। যা বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার ৭৮৯ কোটি এবং সংশোধিত বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আট হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বেশি। বাজেটে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে করা হয় এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ঋণের এ অঙ্ক আগের অর্থবছরের তুলণায় প্রায় দ্বিগুণ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ৬৮ হাজার ৭১ কোটি টাকা।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম দিকে এই ঋণের পরিমাণ কম থাকলেও শেষের দিকে ঋণের চাপ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে শেষ মাসে ঋণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়। একক মাস হিসাবে জুনে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। আগের ১১ মাসে অর্থাৎ গত ৩১ মে সরকারের ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৯২ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। আর ২০ জুন তা বেড়ে এক লাখ ১২ হাজার ২৪১ কোটি টাকা দাঁড়ায়।
অর্থাৎ জুনের প্রথম ২০ দিন সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। তবে ২২ জুন সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে এক লাখ ২৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকাতে পৌঁছায়। অর্থাৎ দুই দিনে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিট ঋণ নিয়েছে ১৫ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ঋণ জোগান দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে কিছু টাকা পরিশোধ করায় অর্থবছরের শেষ দিন ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের যে উৎস থেকে রাজস্ব বাড়ানো উচিত, সেখান থেকে আয় না হওয়ায় কারণে ঘাটতি বাজেট মেটাতে শেষ দিকে ব্যাংকঋণ বাড়িয়েছে সরকার।
এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক ধারায় নেমেছে। বৈদেশিক ঋণ ছাড়েও গতি নেই। ফলে সরকার বাধ্য হয়েই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে। তথ্যমতে, গত ২৬ জুন ছিল গত অর্থবছরের শেষ দিন। কারণ ২৭ তারিখ থেকে শুরু হয় পবিত্র ঈদুল আজহার সরকারি ছুটি। ২৬ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ অর্থবছর শেষে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া এক লাখ ২৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯৮ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা সরবরাহ করেছে। বাকি ২৫ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা এসেছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে সরকারকে যত ঋণ দেয়া হয়েছে এর মধ্যে ৭৮ হাজার ১৪০ কোটি টাকা নতুন টাকা ছাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নাম প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিগত কয়েক বছরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে, তবে এটিই সর্বোচ্চ। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিয়েছে মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তীব্র তারল্য সংকট থাকার কারণে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ যত বাড়বে, মূল্যস্ফীতি তত বৃদ্ধি পাবে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঋণের অর্থ টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশ ব্যাংককে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়নি। খুবই সামান্য নেয়া হতো। সেটি ক্যাশ না থাকার কারণে এক দিনের জন্য হতো। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া নীতিধারা শুরু হয়েছে। এ নীতিধারা চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না; বরং মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিদায়ী অর্থবছর শেষে সরকারের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯৮ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছর ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংক থেকে আরও এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।
এসব বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া মানে বাজারে টাকা ছাড়া, যা মুদ্রাস্ফীতি ও লেনদেন ভারসাম্যের (বিওপি) ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অর্থায়ন কমে যায় বেসরকারি খাতে। ফলে কমে যেতে পারে নতুন কর্মসংস্থান। জনগণের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থাকলে পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে, যা দাম বৃদ্ধি করবে। বিপুল অর্থ বাজারে ছাড়লে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এই কর্মকর্তা। অর্থের প্রচলন বেড়ে গেলে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বেড়ে যায়, যার ফলে আমদানিও বাড়ে।