সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশ বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, কপর্দকহীন একটি দেশ গঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে তখন খাদ্য নেই, অর্থ নেই, ব্যাংক রিজার্ভশূন্য, বিপর্যস্ত অর্থনীতি। সেই সঙ্গে রাস্তা-ঘাট, রেলপথসহ সব যোগাযোগের মাধ্যম এবং অবকাঠামোতে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংসের চিহ্ন। এ রকম একটা ভঙ্গুর এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার মাঝে দেশ গঠনের দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু খাদ্য, স্বাস্থ্য, অর্থ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে ভিত নির্মাণ করেন। আজকে জ্বালানি খাতের যে সুফল পাচ্ছে মানুষ তা বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জ্বালানি খাতের উন্নয়ন জরুরি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। দিনটি ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুজাতিক শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র- তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাশটিলা ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং দিয়ে (তখনকার সময়ে ১৭-১৮ কোটি টাকা) কিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুতসমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্রগুলো এত সস্তায় কিনে নেয়ার ঘটনা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ করছে নামমাত্র মূল্যে কেনা এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো। সে সময়ে নেয়া বঙ্গবন্ধুর এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার মাইলফলক। কারণ বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝেছিলেন দেশে শিল্পায়ন বা উন্নয়ন করতে গেলে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তিনি ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করেন এবং ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১৫০০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করেন। বিদ্যুতের উৎপাদন ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যেখানে ছিল ২০০ মেগাওয়াট, সেখানে ডিসেম্বও ১৯৭২ সালে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ মেগাওয়াট।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সালে দেশব্যাপী পল্লী বিদ্যুৎ কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। সোনার বাংলা বিনির্মাণে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিককরণের ব্যবস্থা, অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রকৌশলী সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে বলেন যে, বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কাজ হয় না, কিন্তু দেশের শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা থাকলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। এর ফলে গ্রামবাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করতে পারলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে না।
স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার ৫৯ (চঙ-৫৯)-এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ৩১ মে ওয়াপদাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের এক নবদিগন্তের সূচনা করেন। ফলশ্রুতিতে সমগ্র দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্ব অর্পিত হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওপর। ১৯৭২-৭৫ সময়ে আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল ও সিদ্ধিরগঞ্জ তিনটি পাওয়ার হাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অপরিসীম গুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশি জ্বালানি ও খনিজসম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই পেট্রোলিয়াম ও সমুদ্র আইনসহ বেশকিছু আইন তৈরি করেছিলেন তিনি। ১৯৭২-এ পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠা করে দেশের খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন, পরিশোধন ও বাজারজাতকরণের সূচনা করেন। ১৯৭৫ সালে মাত্র সাড়ে চার লাখ পাউন্ডে শেল অয়েলের কাছ থেকে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তা জ্বালানির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। সে ধারাবাহিকতায় পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জ্বালানি নিরাপত্তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন। তিনি পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠা, পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট, যুক্তরাষ্ট্রের এসো ইস্টার্ন সরকারিভাবে গ্রহণ করে তেল ও গ্যাস খাতের বিকাশ সুগম করেছেন। জাতির পিতা যেসব ইঞ্জিনিয়ারকে রাশিয়া পাঠিয়েছিলেন, তারাই এখন দেশের বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষেই দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করেছে বর্তমান সরকার। এখন সরকার কাজ করছে নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে। সে লক্ষ্যে কাজও খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও প্রশ্ন আছে গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে সেবার মান নিয়ে। দাম নিয়েও হতাশা আছে মানুষের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন, হয়তো বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিশ্চিত সেভাবেই ভাবছেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করতে নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন। জ্বালানি খাতে দেশকে স্বনির্ভর করা ছিল অন্যতম লক্ষ্য। দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত পরিচালিত হবে এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে দেশে জ্বালানি খাতের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি নীতির সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে জ্বালানি খাত আজ এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট শেষ হলে সরকার নিজস্ব উৎপাদনে মনোযোগী হবে। তবেই চলমান সংকট থেকে উত্তরণ হবে জ্বালানি খাত।