সিস্টেমলস ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। এরই অংশ হিসেবে আবাসিক গ্যাস লাইনে শতভাগ মিটারের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (টিজিটিডিসিএল)।
সংস্থাটি গ্রাহকদের ছয় লাখ ৫০ হাজার প্রিপেইড মিটার দেয়ার জন্য দুই হাজার ২৮৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘স্মার্ট মিটারিং এনার্জি এফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে প্রতি মাসে গ্রাহকের জন্য মিটার ভাড়া ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। যা এখন ১০০ টাকা। দ্বিগুণ বৃদ্ধিতে সব মহলে আলোচনা পর্যালোচনা হচ্ছে। চলমান বাজার পরিস্থিতিতে সব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এরই মধ্যে গ্যাসের মিটার ভাড়া এক লাফে দ্বিগুণ হওয়ার কথা শুনে গ্রাহকের মাথায় চিন্তার ভাঁজ। এর আগে ২০২২ সালের জুলাই মাসে প্রিপেইড মিটারের ভাড়া ৬০ থেকে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানটি। তিতাসের পক্ষ থেকে অথচ তিতাসেরই আরেক প্রকল্পে মিটার ভাড়া ধরা হয়েছে ১০০ টাকা। নতুন ভাড়ায় আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের মিটারের দাম বৃদ্ধি করার এই প্রক্রিয়া কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে না। তারা চাইলেই মিটারের দাম বৃদ্ধি করতে পারে না। দাম বাড়ানো-কমনোর কাজ একমাত্র বিইআরসির। সূত্রে জানা যায়, তিতাসের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৬৩ হাজার। সব গ্রাহকদেরকে মিটারের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও জাপানের জাইকার অর্থায়নে দুটি প্রকল্পে মিটারিং কাজ চলমান আছে। এডিবির অর্থায়নে ইতোমধ্যে আট হাজার ৬০০টি ও জাইকার অর্থায়নে বসানো হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার মিটার। জাইকার অর্থায়নে চলমান প্রকল্পের আওতায় আরও এক লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে আরও ১১ লাখ মিটার স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।
এদিকে প্রতিটি প্রি-পেইড মিটার কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু একই ধরনের অন্য একটি প্রকল্পে প্রতিটি মিটার কিনতে ব্যয় হয়েছিল ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি মিটারে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া একই ধরনের সমাপ্ত একটি প্রকল্পে প্রতিটি প্রি-পেইড মিটারের দাম ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৯০০ টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, এত বেশি দাম ধরার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে দাম ধরে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। সেই সঙ্গে মিটারের এরকম দামের তারতম্য কমাতে দ্রুততম সময়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড সিস্টেম ডিজাইন এবং রেট শিডিউল তৈরির জন্য সুপারিশ দেয়া হয়েছে। অঙ্কের হিসাবে যদি মিটার ভাড়া ১০০ টাকা ভাড়া ধরা হয়, তাহলে এ প্রকল্পে সাড়ে ছয় লাখ মিটারে প্রতি মাসে ভাড়া আসবে ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০০ টাকা হলে ভাড়া আসবে ১৩ কোটি টাকা। বছরে ভাড়া আদায় হবে ১৫৬ কোটি টাকা। পুরোটাই যাবে গ্রাহকের পকেট থেকে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি মোট দুই হাজার ২৮৩ কোটি টাকার। এর মধ্যে সরকার দেবে ৩২৩ কোটি, বৈদেশিক ঋণ এক হাজার ৯৪৫ কোটি ও নিজস্ব অর্থায়ন ১৫ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়িত হবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে থেকে ২০২৮ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে। গত ২ আগস্ট প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) হয়েছে। প্রকল্পটি ঢাকা জেলার উত্তর সিটি কর্পোরেশন, সাভার ও ধামরাই উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্পভুক্ত অন্য এলাকাগুলো হলো— গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, সদর, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর ও কালীগঞ্জেও বাস্তবায়ন করা হবে। আরও আছে টাঙ্গাইল সদর, ঘাটাইল, কালিহাতী, মির্জাপুর ও গোপালপুর, মানিকগঞ্জ সদর, সাটুরিয়া ও শিবালয়, ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন, সদর, মুক্তাগাছা, ভালুকা ও গফরগাঁও এবং জামালপুর সদর ও সরিষাবাড়ী, নেত্রকোনা সদর ও শেরপুর সদর।
গ্যাসের মিটার ভাড়া দ্বিগুণ করার বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, ‘প্রতিটি মিটারের আমাদের কেনা দাম ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। আর মিটারগুলো মেয়াদ থাকবে ১০ বছর। সে হিসাবে আমাদের ভাড়া বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। শুধু মিটারের চুক্তিমূল্যই হিসাব করা হয় না, এটার সার্ভারের চার্জ আছে, অন্য চার্জও আছে।’
মিটারের দাম দ্বিগুণ করার প্রকল্প সম্পর্কে কথা হয় কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলমের সাথে। মুঠোফোনে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘তিতাস গ্যাস এখন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তারা যা ইচ্ছা তাই করছে। মিটারের দাম বাড়ানো তাদের কোনো এখতিয়ার নেই। দাম বাড়ানো কমানোর কাজ বিইআরসির।’ তিনি আরও বলেন, তিতাস তো গ্রাহকদের নিয়মিত সেবাই দিতে পারছে না। গ্যাস সংকটে গ্রাহকের ঘরে চুলা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যেই দাম বাড়ানো অযৌক্তি ও অনিয়মের মধ্যে পড়ে। এটি গ্রাহকের ঘাড়ে বাড়তি চাপ। ‘তিতাস লুটপাট শুরু করেছে। দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে’ -তিনি যুক্ত করেন।
উল্লখ্য, বাসাবাড়িতে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপন শুরু হয় ২০১৭ সালে। ২০১১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে তা শুরু হয়েছিল। শুরুতে সরকারের গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর বেশ আগ্রহ ছিল মিটার স্থাপনে। পরে আর নতুন মিটার স্থাপনে অনীহা পরিলক্ষিত হয় কোম্পানিগুলোতে। এর আগে ২০২২ সালের প্রিপেইড মিটারের ভাড়া ৪০ টাকা বাড়িয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ।