- বিজ্ঞপ্তির পাঁচ বছরেও নিয়োগ হয় না
- দীর্ঘসূত্রতায় হতাশা ভর করে চাকরিপ্রত্যাশীদের
- আমলাদের গাফিলতিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা
আমলারা চাইলেই যে কোনো চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা দুই মাস থেকে এক বছরের মধ্যে শেষ করা সম্ভব
—একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার সাবেক সচিব
সরকারি চাকরিতে পদ খালি হওয়াসাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা বর্তমানে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক সরকারি অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তির পাঁচ বছরেও নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারছে না। নিয়োগের এই দীর্ঘসূত্রতার ফলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চাপে থাকছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। এতে অনেকে হতাশ হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ উপায় না পেয়ে বেসরকারি বা ছোট চাকরি বেছে নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমলাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও গাফিলতিতেই এমনটি হচ্ছে। সাবেক আমলারা মনে করেন, কর্মকর্তারা চাইলেই দুই মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া সম্ভব।
সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসের ৯ তারিখে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ৯৬০ পদে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। এরপর ২০২২ সালে পরীক্ষা নেয়া হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) নেয়া হলেও এখনো চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়নি।
৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর। ২১৬৬ পদের বিপরীতে তখন আবেদন করেন চার লাখের বেশি প্রার্থী। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশ করা হয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রায় দুবছর পর। ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এক বছর পর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। এরপর গত ২৬ জুন তাদের মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়। গত ৫ আগস্ট ফল প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ ৪১তম বিসিএসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে লেগে গেল প্রায় চার বছর।
রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে ২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। দীর্ঘ চার বছর পর ২০২২ সালের ৩ আগস্ট চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুলাই মাসের ৯ তারিখে তাদের চূড়ান্ত নিয়োগ হয়েছে।
২০২১ সালের জুলাই মাসের ১১ তারিখে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে ২০৬ পদের নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পরীক্ষা হয়নি। এ ব্যাপারে ডাক বিভাগের পরিচালক আলতাফুর রহমান (কর্মী ও সংস্থাপন) বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকটি বিভাগের পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। বাকিগুলো আমরা শিগগিরই নেয়ার ব্যবস্থা করব।
জানা যায়, সরকারি চাকরিতে বয়সের সর্বোচ্চ সীমা ৩০ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বয়সসীমা ৩২ বছর। সাধারণত একজন শিক্ষার্থীর অনার্স শেষ হতে বয়স হয়ে যায় ২৩-২৫ বছর। পরবর্তী পাঁচ থেকে সাত বছর তারা বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করেন।
নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতার কারণে চাপে থাকছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। নিজের হতাশার কথা জানিয়ে নাঈম আব্দুল্লাহ নামে এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতার ফলে আমাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপ এসে ভর করে। অনার্স শেষে পরিবার চায় একটা চাকরি করি। দীর্ঘ ১৭ থেকে ১৮ বছর পড়াশোনা শেষে চাকরি পেতে দেরি হলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা কথা শুনতে হয়। এ সময় সংসারের হাল ধরারও একটা চাপ থাকে। নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে আমাদের হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। ফারজানা ইয়াসমিন নামে আরেক চাকরিপ্রার্থী বলেন, মেয়ে হিসেবে পরিবার ও সামাজিক চাপ আমাদের বেশি পোহাতে হয়। অনার্স-মাস্টার্স শেষে পরিবার চায় আমাদের দ্রুত বিয়ে দিতে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার আগে বিয়ে করা মানে জীবনকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেয়া। সেজন্য দ্রুত চাকরি পাওয়ার জন্যই প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু এক নিয়োগে চার-পাঁচ বছর সময় লাগছে। কিন্তু এটা দেখার কেউ নেই।
নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে সরকারি কর্মকমিশনের সদস্য মাকসুদুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা দীর্ঘ হওয়ার ক্ষেত্রে আমলাদের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি জড়িত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আমলাদের গাফিলতিও দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে কাউকে দায় দেয়া যায়। এটা একটি টিম ওয়ার্ক। এই টিম ওয়ার্কে একজন দেরি করলে পুরো প্রক্রিয়ায় সময় বেশি লাগে। তরুণদের দিকে তাকিয়ে এই কাজগুলো আরও দ্রুত সময় করা উচিত।
চাকরিতে দীর্ঘসূত্রতা কাম্য নয় জানিয়ে সাবেক সচিব একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, সরকারি নিয়োগ পরীক্ষা আমলারা চাইলেই দুই মাসের মধ্যে নিতে পারেন। তবে বড় ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা হলে সর্বোচ্চ এক বছর সময় লাগতে পারে। চাকরির সার্কুলার থেকে শুরু করে যে কোনো নিয়োগ পরীক্ষাতেই এর চেয়ে বেশি দেরি করা ঠিক নয়। তরুণদের পরিবার-আত্মীয় সবারই চাওয়া একটি চাকরি। তাদের বয়সও সীমাবদ্ধ। এমতাবস্থায় আমলাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত। ভারতেও চাকরির পরীক্ষায় ১১ মাসের বেশি সময় নেয় না।