সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালান স্বল্প আয়ের মানুষ
- মারাত্মকভাবে বিপদে পড়েছেন ৮৪ শতাংশ মানুষ
- ডাল, পেঁয়াজ, চাল, আটার দাম ঊর্ধ্বমুখী
- সবজির বাজার চড়া, ঝাঁজ পেঁয়াজ-আলুতেও
- ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া
- নীরবেই ওষুধের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে
দ্রব্যমূল্য বাড়ার সঙ্গে মানুষের আয় বাড়লে ভোক্তার কষ্ট কম হতো— ক্যাব
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তুলছে। নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত মানুষরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। নিয়মিত আয়ে সংসার চলে না তাদের। সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ চালান অনেকে। অনেকে চলছেন ধারকর্য করে। মানুষ এখন নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কতিপয় ডিন্ডিকেট পুরো দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা নানা অজুহাতে দ্রব্যমূল্য ইচ্ছেমতো বাড়াতে থাকে। সরকারি কোনো সংস্থাও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মাছ-মাংস, চাল-ডাল, ডিম, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের দাম কয়েক মাস ধরেই ঊর্ধ্বগতিতে। দাম বেড়েছে দফায় দফায়। ব্যবসায়ী ও বাজার নিয়ন্ত্রক-সংশ্লিষ্টরা বারবারই দাম কমানোর আশ্বাস দিয়ে আসছে। তবে কোনো কার্যকারিতা নেই তাতে। ভোক্তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে, দেশে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা ত্বরিত কার্যকর হয়। তবে দাম কমলে তা বাজারে আর দৃশ্যমান হয় না। তারা বলছেন, ব্যবসায়ীদের অতিলোভের কারণে বাজারে পণ্যের দাম কমছে না।
দেশে ঊর্ধ্বগামী বাজারের কারণে ৮৪ শতাংশ মানুষের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশ ভুল পথে যাচ্ছে বলে মনে করেন আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ। অন্যদিকে বেশিরভাগ মানুষ বলছেন, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি তাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
দেশের মানুষের এই মতামত উঠে এসেছে দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে। এতে বলা হয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেশের ভুল পথে যাওয়ার কথা বলেছেন প্রায় ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা। আর নিজেদের জীবনে দ্রব্যমূল্যের আঘাত মারাত্মকভাবে পড়ার কথা বলেছেন ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা।
জরিপটি গত মঙ্গলবার এশিয়া ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। দেশের ৬৪ জেলার ১০ হাজার ২৪০ জনের ওপর করা এই জরিপে তথ্য নেয়া হয় গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি সময়ে। প্রতিটি জেলা থেকে ১৬০ উত্তরদাতা নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অর্ধেক ছিলেন নারী।
দীর্ঘদিন ধরেই নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি নেই। বাজারে মোটা চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ও সবজির বাড়তি দামে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাল দুই থেকে তিন টাকা, মসুর ডাল কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা এবং আলু প্রতি কেজি পাঁচ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি মাছ-মাংসের বাজার, কাঁচাবাজার, এমনকি মশলাজাত পণ্যের দামও বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
সপ্তাহজুড়ে ঝাঁজ বেড়েছে পেঁয়াজের। ভালো মানের দেশি পেঁয়াজের কেজি গত সপ্তাহে ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে থাকলেও এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। মাঝারি মানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি।
হাতিরপুর বাজারের এক চাল ব্যবসায়ী বলেন, তিন দিন আগে বিআর-২৮ চাল কিনেছেন প্রতি কেজি ৫২ টাকা দরে; এখন ৫৫ টাকা। স্বর্ণা চালের সরবরাহ না থাকায় প্রভাব পড়েছে অন্যান্য মোটা চালের দামে। বেড়েছে পাইজামের দামও। তবে তিনি বলেন, সরু চালের দাম বাড়েনি। এখন মিনিকেট ৬৮ থেকে ৭০ টাকা ও নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, যা গত সপ্তাহেও একই ছিল।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে ন্যূনতম ৫০-৬০ টাকার কমে কোনো সবজি মিলছে না। প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০, আলু ৪০ থেকে ৫০, বড় আকারের লম্বা বেগুন ১১০, গোল বেগুন ৯০-১০০, ফুলকপি প্রতিটি ৫০-৬০, কাঁকরোল ৮০ ও কাঁচা পেঁপে ৫০-৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বাজারভেদে পটোল, ঝিঙা, বরবটি, শসা, কচুরমুখী ও করলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৯০ টাকায়। এছাড়া শসা ৬০-৭০, মুলা ৬০, ধুন্দল ৮০, ঢেঁড়স ৮০, চিচিঙ্গা ৬০, আকারভেদে লাউয়ের পিস ৮০ ও চালকুমড়া ৭০-৮০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মাছের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আকারভেদে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে পাঙ্গাস বিক্রি হচ্ছে। বড় ও মাঝারি তেলাপিয়া ২৩০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজির রুই-কাতলের ফাম হাঁকানো হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা। দুই থেকে আড়াই কেজি ওজনের রুই-কাতল মাছের দাম প্রতি কেজি ৩৭৫ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শোল প্রতি কেজি ৬০০-৬৫০ টাকা। শিং, বাইলা মাছ প্রতি কেজি প্রকারভেদে ৬০০-৬৭০ টাকা।
এদিকে মাংসের বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগি ১৭০ থেকে ১৮০, সোনালি মুরগি ৩০০ থেকে ৩২০, দেশি মুরগি ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি। গরুর মাংস ৮০০, খাসির মাংস ১১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এদিকে বোতলজাত পানির দাম ক্রমাগতভাবে বাড়ছে; এটি কেউ দেখছেন না। যাদের নিয়মিত পানি কিনে পান করতে হয়, দাম বাড়ার কারণে তাদের কষ্ট বেড়ে গেছে। আধা লিটারের বোতলজাত পানির দাম ১৫ থেকে বেড়ে একবারে ২০ টাকা হয়ে গেছে। বড় বোতলের দামও বেড়েছে। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দেশে বেশকিছু কোম্পানি বোতলজাত পানি বিক্রি করছে। এ বছরের জানুয়ারির পর ধাপে ধাপে সব কোম্পানি আধালিটার পানির দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করেছে। এর আগে সাধারণত পানির দাম ১-২ টাকা করে বাড়ত। এবার এক লাফে পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
বর্তমানে বাজারে দুটি কোম্পানির পানি ছাড়া সব কোম্পানির আধালিটারের পানির বোতল বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। এক লিটার বোতলের আগের দাম ছিল ২০ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। আগে দুই লিটারের এক বোতল পানি বিক্রি হতো ৩০ টাকায়, প্রথম দফায় পাঁচ টাকা দাম বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়। দ্বিতীয় দফায় বাড়িয়ে বর্তমানে তা ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে পাঁচ লিটারের পানির বোতল ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে।
এদিকে ওষুধের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে নীরবেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হলেও এক্ষেত্রে ওষুধ যেন ব্যতিক্রম। একটু একটু করে নাগালের বাইরে চলে গেছে ওষুধ কেনার সামর্থ্য। যেনতেন কোম্পানির চেয়ে নামিদামি ওষুধ কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ছোটখাট ফার্মেসি থেকে শুরু করে রাজধানীর বড় বড় ফার্মেসিতে জ্বর-ঠাণ্ডা থেকে শুরু করে প্রেশার, ভিটামিন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ প্রায় সব ওষুধের দাম একেবারে লাগামহীন হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে না বাড়ছে, মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করা ওষুধের দাম তার চেয়ে বেশি বাড়ছে। বিভিন্ন বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে ওষুধের বাড়তি দামের এমনই ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।
কোন কোন ওষুধের দাম বাড়ছে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর থানার বনগাঁও বাজারের জনি ফার্মেসির নাইমুল হক মালি বলেন— ধান, চাল, সবজির চেয়ে ওষুধের দাম ইচ্ছেমতো বাড়াচ্ছে কোম্পানিগুলো। করোনার পর থেকেই এভাবে কয়েক মাস যেতে না যেতে বেড়েই যাচ্ছে ওষুধের দাম। ফলে রোগীরা খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন।
অনিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ক্যাবিনেটে ৬২ শতাংশই ব্যবসায়ী। সংসদ ও সরকারের মধ্যে রাজনীতিবিদদের তুলনায় ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য থাকলেও নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন, মনিটরিংয়ে তার প্রতিফলন নেই।
গোলাম রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্যের আগুনে দাহ হওয়া ভোক্তাদের কেবল বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্বস্তি দেয়া সম্ভব নয়। সরকার বলছে সিন্ডিকেট নেই। কিন্তু কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে সেটা কী সিন্ডিকেট নয়? বাজারে যদি মানি সাপ্লাই বাড়ে, তাহলে পণ্যমূল্য বাড়ে। দ্রব্যমূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয় বাড়লে এবং কর্মসংস্থান তৈরি হলে ভোক্তাদের কষ্ট কম হয়।