আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, গেমিং, বেটিং, এমএলএম, ই-কমার্সসহ অভিনব সব পন্থায় অর্থপাচার অব্যাহত রয়েছে। কার্যকর উদ্যোগের অভাবে পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পতনের পাশাপাশি উত্তপ্ত ডলার মার্কেট। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ডলার কারসাজিতে জড়াচ্ছে ব্যাংক ও মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতিতে। এ ছাড়া জ্বালানিসহ সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে যাতায়তাসহ জীবন ধারণের সব খাতে ব্যয় বেড়েছে। পর্যাপ্ত ডলারের অভাবে আমদানিতে লাগাম টেনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। যার নেপথ্য প্রধান কারণ হিসেবে অর্থপাচারকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এতদিন পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) আমদানির মাধ্যমে অর্থপাচার হচ্ছিল। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি এলসি পরীক্ষা শুরু করে। এতে দেখা যায় ২০০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার করছিল একাধিক চক্র। এর লাগাম টানতে আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়নি। এরপর বেরিয়ে আসে রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে (আন্ডার ইনভয়েসিং) অর্থপাচারের তথ্য। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে রেমিট্যান্সের অর্থ। গেমিং, বেটিং, এমএলএম ও ইকমার্সের মাধ্যমেও অর্থপাচার অব্যাহত রয়েছে।
ডলার-সংকটের কারণ প্রসঙ্গে অর্থপাচার প্রতিরোধ সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বেশি দেখিয়ে কোনো কোনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে। নজরদারি জোরদার করার ফলে এখন তা হচ্ছে না। এটি ঠেকানো গেছে। এখন কর ফাঁকি দিতে মূল্য কম দেখিয়ে যা আমদানি হচ্ছে, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। এ তালিকায় রয়েছে গড়ি। এদিকেও তদারকি জোরদার করা হচ্ছে।’
রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বেশি দামের পণ্য কম দামে এলসি খুলে বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি মাত্র ২০ হাজার ডলারে আমদানির ঋণপত্র খোলা হচ্ছে। বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েস (আমদানি মূল্য বাড়িয়ে দেখানো) হয়েছে। সম্প্রতি বেরিয়ে এসেছে রপ্তানির মাধ্যমে অর্থপাচারের তথ্য।
গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে অর্থপাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে প্রতারকচক্র। তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে ৯৩৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে এনেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। বাকি ৮২১ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে পাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে প্রতারকচক্র।
সংস্থাটির তদন্ত নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব পণ্য রপ্তানি করতে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ কম মূল্য দেখানোর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যকে ‘নমুনা’ পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। নমুনা পণ্য হিসেবে দেখানোর কারণে এসব পণ্যের বিপরীতে দেশে কোনো টাকা প্রবেশের সুযোগ নেই। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইআইডি) চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে তিন ধাপে ছয় মাসের তদন্তের পর এ জালিয়াতি উদঘাটন করেছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থপাচারের জন্য প্রতারকরা এনবিআর সার্ভারে কোড-২০ ব্যবহার করে, যা প্রকৃত রপ্তানির আগে আমদানিকারকদের কাছে ‘নমুনা’ প্রেরণের নির্দেশ করে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের প্রশ্নই আসে না।
এ ছাড়া আন্ডার ইনভয়েসিং বা প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো বা পণ্যের পরিমাণ কম দেখানোর মাধ্যমে ২৯টি প্রতিষ্ঠান অর্থপাচার করেছে। পাচারের কারণে ডলার বাজারে যে অস্থিরতা চলছে তার সুযোগ নিয়ে ডলার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ছে ব্যাংক ও মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান। কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি সাতটি মানিচেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া আরও ১০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় গত রোববার থেকে বেশ কিছু ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংক ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে আমদানিকারক ও কর্পোরেট গ্রাহকদের কাছে ডলার বিক্রি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযোগ, এসব ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রানীতি ও মুদ্রানীতি পরিপন্থি কার্যকলাপ করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে ব্যাংকগুলো বলছে সময়মতো বিদেশি ব্যাংকের আমদানি দায় পরিশোধ করতে বাধ্য হয়ে তাদেরকে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। কারণ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাবদ পর্যাপ্ত ডলার সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকতারা জানান, বাজারে ঘোষিত দামে ডলার পাওয়া যায় না। তাই বেশি দামে ডলার কিনতে হয়। এ জন্য বিক্রির ক্ষেত্রেও বেশি দাম নেয়া হয়েছে। ব্যাংক সময়মতো আমদানি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে না। আবার ব্যাংকপ্রতি ডলারে চার-পাঁচ টাকা লোকসানও করতে পারে না। এর আগে ২০২২ সালে ডলারে অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগে দেশি-বিদেশি ১২ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারে অতিরিক্ত মুনাফা করা ৫০০ কোটি টাকা সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে (সিএসআর) ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার চক্র অধিক সক্রিয়। এর প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্সে। কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্স তো আসছেই না; বরং দিন দিন কমে যাচ্ছে প্রবাসী আয়। সদ্য সমাপ্ত আগস্ট মাসে দেশে প্রবাসী আয় কম এসেছে আগের জুলাই মাসের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ।
আগস্টে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আর আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। পরিমাণের দিক থেকে এক মাসের ব্যবধানে দেশে প্রবাসী আয় কম এসেছে ৩৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। প্রবাসী আয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যাচ্ছে, গত বছরের একই মাস অর্থাৎ আগস্টের তুলনায় প্রবাসী আয় কমছে আরও বেশি হারে। যেমন এবারের আগস্টে প্রবাসী আয় ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪ কোটি ডলার কম এসেছে। গত বছরের আগস্টে প্রবাসী আয় এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার। গত ছয় মাসের মধ্যেই এই আগস্টে প্রবাসী আয় এসেছে সবচেয়ে কম।
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। অর্থপাচার প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা খর্ব করার সমালোচনা করে টিআইবি বলছে, ‘অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত অনেকগুলো অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত দুদকের এখতিয়ার থেকে সরিয়ে নেয়ার ফলে অর্থপাচারের ক্ষেত্রে দুদক তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯ সংশোধন করে দুদকের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার জোর দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
অন্যদিকে সিঙ্গাপুরে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্তের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। গত সোমবার জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এ আহ্বান জানান।