- আইনের ফাঁকফোকরে পার পাচ্ছে অপরাধীরা
- লোকলজ্জার কারণেও বিচার চাচ্ছেন না অনেকে
- বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় আগ্রহ হারাচ্ছেন ভুক্তভোগী
- রাজনৈতিক প্রশ্রয়েও পার পাচ্ছে অপরাধীরা
সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে বিচার চাইতে আগ্রহী হন না ভুক্তভোগী
—অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক, চেয়ারম্যান
অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষীদের দ্রুত কোর্টে না আনতে পারায় নির্দিষ্ট সময়ে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব হয় না
—মফিজুর রহমান মোস্তাফিজ
অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজকোর্ট
আমরা এখন পর্যন্ত বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না
—মো. নূর খান লিটন, নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা সামাজিক অপরাধ ক্রমেই বাড়ছে। প্রতি বছরই আগের বছরের রেকর্ড ভাঙছে। কিছু ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের বিচার চাওয়া হয়, মামলাও হয়; কিন্তু প্রয়োজনীয় সাক্ষীর অভাব ও বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর পার হলেও বিচার পাওয়া যায় না। ফলে অনেক ভুক্তভোগী আক্রান্ত হলেও বিচার চাইতে আগ্রহ হারান। আবার অনেকে লোকলজ্জা ও সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হলেও নিশ্চুপ থাকছেন। যথাসময়ে বিচার না হওয়া ও বিচার চাইতে না যাওয়ার কারণে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মানবাধিকারকর্মীদের ভাষ্য হচ্ছে— আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ করেও আইনের ফাঁকফোকরে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। আবার অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণেও বিচার পান না ভুক্তভোগী, যা একটি জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
উচ্চ আদালতের তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিচারাধীন মামলা এখন দেড় লাখ ছাড়িয়েছে। ৬৪ জেলায় ৯৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট বিচারাধীন মামলা এক লাখ ৬১ হাজার ২১৮টি। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৪ হাজার ৩১৪টি। ২০২২ সালে এবং চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলার ৫২ শতাংশই ধর্ষণের। এর মধ্যে ২১ শতাংশ মামলা পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন। যদিও ট্রাইব্যুনালের মামলা ৩৬০ দিনে শেষ হওয়ার কথা। অবশ্য আইনের দৃষ্টিতে মামলা নিষ্পত্তি করতে বেঁধে দেয়া সময় ১৮০ দিন হলো নির্দেশনামূলক, তবে বাধ্যতামূলক নয়। মামলা তদন্তের সময় মেডিকেল সনদ, ফরেন্সিক রিপোর্ট হয় না (আলামত পোশাক), ডিএনএ প্রতিবেদন (ধর্ষণের মামলায় আবশ্যক) পেতে বিলম্ব, বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর পর চিকিৎসক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার এবং মামলার বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য পেতে বছরের পর বছর পার হয়ে যায়।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য থেকে জানা যায়, নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতন। গবেষণার তথ্য অনুসারে, পারিবারিক নির্যাতনের ৯৭ ভাগ ক্ষেত্রে মামলা হয় না। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হওয়া মামলার বেশিরভাগই ‘ভুয়া’ বলার প্রবণতা, অভিযোগ গ্রহণে দেরি, ভুল ধারায় মামলা করা, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাব, আলামত নষ্ট হওয়া, সাক্ষীকে উপস্থিত করতে না পারা ইত্যাদি কারণে অনেক সময় অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না; বরং মামলা তদন্তে অদক্ষতা ও মামলা পরিচালনায় গাফিলতি আর দীর্ঘসূত্রতায় বিচারহীনতার শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
রাজধানীতে আট বছর আগে ধর্ষণের শিকার এক নারীর পরিবারের একজন সদস্য নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই তাদের যেমন নিরাপত্তার অভাব ছিল, একইসঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ইতোমধ্যে দীর্ঘ সময় পার হলেও বিচার পাওয়া যাবে কি না— সে সংশয় থেকে এক পর্যায়ে তারা অভিযুক্ত পক্ষের সঙ্গে বাধ্য হয়ে আপস করেছিলেন। এমন অনেক ঘটনাই ঘটে বলে মানবাধিকারকর্মীরা জানিয়েছেন। তারা আরও জানান, ধর্ষণের বিচার না পাওয়ার কারণে ভুক্তভোগীদের মধ্যে এক ধরনের চরম হতাশা তৈরি হয়।
২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড জারি করে সরকার। এ সাজা বাড়ালেও ধর্ষণের ঘটনা কিন্তু কমেনি। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৯ হাজারের বেশি এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১৮ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। দুই বছরের এ মামলার ৫২ শতাংশই ধর্ষণের, আগের চার বছরে এই হার ৪৮ শতাংশের নিচে ছিল।
সম্প্রতি নাটোরের গুরুদাসপুরে ধর্ষণের শিকার এক স্কুলছাত্রী কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। ওই ছাত্রীর দাদি দৈনিক আমার সংবাদকে জানান, আমার নাতনি ১০ মাস আগে প্রতিবেশী এক বৃদ্ধ জাহিদুলের (৫৮) ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয় পড়ে। অবশেষে ৪র্থ শ্রেণির স্কুলছাত্রী নাতনিটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। ওই ছাত্রী জানায়, ধর্ষক প্রায়ই ভ্যানযোগে তাকে স্কুলে আনা-নেয়া করত। ঘটনার দিন স্কুলে যাওয়ার জন্য গোসল করে বাড়ির ভেতর কাপড় পরিবর্তন করছিল শিশুটি। বাড়িতে কেউ না থাকায় ঘরে ঢুকতেই পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে মুখে গামছা পেঁচিয়ে ধর্ষণ করে জাহিদুল। বিষয়টি কাউকে জানালে শিশুটিকে মেরে ফেলার হুমকি দেন তিনি। ফলে ওই ঘটনা কাউকে বলতে সাহস পায়নি শিশুটি। স্কুলছাত্রীর দাদি আরও জানান, এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। পারিবারিক কলহের কারণে শিশুটির বাবা-মায়ের সংসার ভেঙে যায়। পরবর্তীতে বাবা ও মা অন্যত্র বিয়ে করে। এরপর থেকে শিশুটি আমার কাছে থাকছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক আমার সংবাদকে বলেন, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হতে হবে ভেবে এবং আইনি কাঠামোয় কার্যকর সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না থাকায় নারীরা বিচার চাইতে আগ্রহী হন না। প্রকৃত ঘটনা অনুযায়ী রিপোর্টও হয় না। যদিও আইনকে নতুনভাবে সংস্কার করা হয়েছে; কিন্তু আইনের মূল ধারাগুলো পরিবর্তন হয়নি। ফলে আমাদের বিচারব্যবস্থা থাকলেও ইনভেস্টিগেশনের দুর্বলতার কারণে অনেকেই মনে করেন সামাজিকভাবে অপদস্ত হতে হবে, তাই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। তিনি আরও বলেন, ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও মামলা পরিচালনার দুর্বলতায় অনেক মামলা প্রমাণিত হয় না। মিথ্যা মামলার হার মাত্র ১০ শতাংশ হলেও এ বিষয় তুলে ৯০ শতাংশ সত্য মামলাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। এসব কারণে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয়। ভুক্তভোগীকে দ্রুত বিচার পাইয়ে দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন উমর ফারুক। তিনি বলেন, আসামির কাছ থেকে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে পৃথক আইনের প্রয়োজন। ভারতে এসব খরচ রাষ্ট্র বহন করে এবং ভিকটিমকে নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। কারণ, এ ব্যাপারে নারী শুধু সামাজিকভাবেই নয় বরং অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধর্ষণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ প্রযুক্তির অপব্যবহার। বড় দুর্বলতা হচ্ছে ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে প্রভাব থাকে, অনেক রিপোর্ট এবং প্রান্তিক অনেক ভিকটিম সহযোগিতা পান না। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সঠিক রিপোর্ট পেতে বেশি সময় ব্যয় হয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলামত নষ্ট হয়ে যায়।
ঢাকা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট মফিজুর রহমান মোস্তাফিজ আমার সংবাদকে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২২ ধারায় জবানবন্দি নেয়া হয়। বিচার দ্রুত না হওয়ার প্রধান কারণ হলো সাক্ষী কোর্টে আসেন না। তাদের দ্রুত কোর্টে না আনতে পারায় নির্দিষ্ট সময়ে মামলা নিষ্পত্তিও সম্ভব হয় না। ৩৬০ দিনে মামলা নিষ্পন্ন হওয়ার কথা। তবে আইনের দৃষ্টিতে ১৮০ দিন হলো নির্দেশনামূলক, বাধ্যতামূলক নয়।
আইনের নির্দেশনা প্রতিপালনের কোনো উদ্যোগ নেই উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, বাস্তবিক অর্থে ট্রাইব্যুনালে অনেক বেশি মামলাজট রয়েছে, এসব মামলা সাক্ষীর মাধ্যমেই শেষ করতে হয়। আমাদের আইন ২০০৩ এবং সর্বশেষ ২০২০ সংশোধন করা হয়েছে। বিশেষ করে ১১(গ) কম্পাউন্টাবল করা হয়েছে (আপস) এবং প্রচুর মিথ্যা মামলা হচ্ছে। গ্যাং রেপের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট আইনে রেখে অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে এ মুহূর্তে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। বিচারব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান লিটন আমার সংবাদকে বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে আমরা এখন পর্যন্ত বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। বিশেষ করে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনাগুলো বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে যে সংখ্যাটি আমরা জানতে পারি, থানা বা কোর্টে অভিযোগ আকারে যা আসছে, সেগুলো কিন্তু আসল ঘটনার সংখ্যা থেকে অনেক কম। আমাদের যে আইন রয়েছে, তার প্রয়োগের দিকটা খুবই দুর্বল। তার মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বেশ কিছু কারণও রয়েছে। তাছাড়া অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার একটা প্রবণতা তো এখন সবার কাছেই দৃশ্যমান। এসব কারণে আইনের সঠিক প্রয়োগও হচ্ছে না। মূলত অনেক ক্ষেত্রে সমাজে বিচারহীনতার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এখান থেকে বের হতে না পারলে কোনো অপরাধই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।