ঢাকায় পরিবহনের চেয়ে হাঁটার গতি বেশি

আব্দুল কাইয়ুম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩, ১১:৪৬ পিএম
ঢাকায় পরিবহনের চেয়ে হাঁটার গতি বেশি
  •  পিক টাইমে বাহনের গড় গতি ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার 
  • মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতি প্রতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার 
  • যানবাহনের ধীরগতির কারণে অনেকে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছান
  • যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়

ঢাকায় সড়কের সক্ষমতার চেয়ে গাড়ির পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি
—মো. হাদিউজ্জামান, পরিচালক, এআরআই, বুয়েট

ব্যক্তিগত গাড়ির অবারিত ব্যবহারের ফলে পরিবহনের গতি কমে গেছে 
—স্থপতি ইকবাল হাবিব, নগরবিদ

যানজটে প্রতিদিন মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। এতে করে কাজের যেমন ব্যাঘাত ঘটে তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে গোটা জীবনের বড় একটা অংশ। বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার সড়কে পিক টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি হচ্ছে ৪.৮ কিলোমিটার। যা একজন সাধারণ মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম। দুই বছর আগেও এই গতি ছিল প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। কারণ একজন সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে হাঁটলে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে যেতে পারে। ফলে একজন মানুষ ইচ্ছে করলে হেঁটেই গাড়ির আগে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।

পরিবহনের ধীরগতির ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। জরুরি কাজে গাড়িতে উঠলেও জ্যামের কারণে সঠিক সময়ে তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার পথে সময় মতো পৌঁছাতে না পেরে মৃত্যুর ঘটনাও কম নয়। তাছাড়া ঠিক সময়ে যেতে না পারায় শিক্ষার্থীরা তারদের ক্লাস করতে পারছে না। পরিবহনের ধীরগতির কারণে সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছতে না পারায় অনেকের চাকরিও চলে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে পিক টাইমে রাজধানীর অধিকাংশ মানুষ গাড়ি থেকে নেমে হেঁটেই তাদের গন্তব্যে যায়। 

রাজধানীর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) সূত্র জানায়, ২০৩০ সালের দিকে সড়কে যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমে আসতে পারে। বর্তমানেই তার দৃশ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি। সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে সড়কে উন্নয়ন ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবে। গণপরিবহনের করুণ অবস্থার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা সড়কের সক্ষমতার চেয়ে গাড়ির পরিমাণ বেশিকে দায়ী করছেন। যেখানে অধিকাংশ হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যা জাতীয় বাজেটের ১১ ভাগের এক ভাগ। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮০ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল তিন মিলিয়ন এবং ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৮ মিলিয়নের বেশি। ১৯৮০ সালে গাড়ির গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার এবং এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারেরও কম। এতে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ২০৩৫ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ মিলিয়নে। ফলে যানবাহনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে যানজট। বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৯ সালের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার বেগে ঢাকাতে গাড়ি চলাচল করে। আর একজন মানুষ প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে হাঁটতে পারে। ঢাকায় প্রতি বছর যানজট ও ধীরগতির কারণে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে আনুমানিক তিন থেকে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ। 

বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা প্রকাশনী সংস্থা ‘প্লাস ওয়ান জার্নাল’ এক গবেষণায় বলছে, সাধারণত ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সি মানুষ প্রতি ঘণ্টায় ৪.৯ কিলোমিটার গতিতে হাঁটতে পারে। ৩০ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব বয়সি মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫.১ কিলোমিটার। ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে এই গতি ঘণ্টায় ৪.৮২ কিলোমিটার আর সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ঘণ্টায় হাঁটতে পারেন ৪.৫ কিলোমিটার। যেটি বর্তমানে পিক টাইমে ঢাকার সড়কে চলা গাড়ির গতির চেয়েও বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সড়ক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংগঠন যারা আছেন তাদের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। রাস্তা তৈরি করছে সিটি কর্পোরেশন আর গাড়ির নিবন্ধন দিচ্ছে বিআরটিএ। গাড়ি আমদানির অনুমতি দিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অথচ এদের কাজের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। সিঙ্গাপুরের ৭০ শতাংশ যানবাহন রাস্তায় নামায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে এখনো ৩০ শতাংশ রাস্তা ফাঁকা রেখেছে দেশটি। তারা একটি নতুন গাড়ি নিবন্ধন দিতে পুরাতন একটি গাড়িকে বাদ দেয়া হয় এই নিয়ম রক্ষা করে। আমাদের দেশে যে পরিমাণ সড়ক আছে তার পঁচি-ছয়গুণ বেশি গাড়ি আছে। মিশ্র ট্রাফিক থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক গাড়ি এক সাথে চললে কখনো গতি বাড়ানো সম্ভব না। ট্রাফিক পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করতে পারলে কিছুটা গতিশীলতা বাড়বে। সিটি বাস সার্ভিসকে বাড়িয়ে ও উন্নতভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি বাড়তে দেয়া যাবে না।

নগরবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব আমার সাংবাদকে বলেন, ফুটপাতবান্ধব ঢাকা শহর কখনো হতে পারেনি। তাছাড়া ফুটপাত দিয়েও মানুষ ঠিক মতো হাঁটতে পারে না। আর রাস্তায় গাড়ি চলার মতো অবস্থাও নাই। গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে সব কিছু সাধারণ রয়ে গেছে। ব্যক্তিগত গাড়ির অবারিত ব্যবস্থার ফলে আজকের এই অবস্থা। মেট্রোরেলের সবগুলো রুট চালু হলে মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ চলাচল করতে পারবে। আমরা এখনো গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে সড়ক তৈরি করতে পারিনি। গণপরিবহনগুলোতে ঠিকমতো মানুষ চলতে পারে না। ৮০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহনে ভরসা করে চলাচল করে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, রাজধানী ঢাকাতে যে পরিমাণ সড়ক আছে তার সক্ষমতা বিবেচনা না করেই প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়ি নামানো হচ্ছে। ঢাকা অনেক আগেই  সড়কের সক্ষমতা থেকে গাড়ির পরিমাণের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। নতুন নতুন গাড়ি নামলেও সড়কের পরিমাণ বাড়ছে না। সড়কের সক্ষমতার চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় গতিও কমে যাচ্ছে। কারণ নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি চলতে পারে না অধিক গাড়ির ফলে। এতে করে সড়কে জ্যাম সৃষ্টি হয়।

মো. হাদিউজ্জামান বলেন, একজন সুস্থ মানুষ স্বাভাবিকভাবে হাঁটলে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে হাঁটতে পারে। বুয়েটের মাধ্যমে আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ঢাকাতে পিক আওয়ারে যানবাহনের গতি প্রতি ঘণ্টায় ৪.৮ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ থেকেই বুঝা যায় হাঁটার গতির চেয়ে পিক আওয়ারে গাড়ির গতি কিছুটা কম। অতিমাত্রার যানজটের পেছনে অনিয়ন্ত্রিত ছোট ছোট যানকেও দায়ী করা যায়। বিআরটিএর (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) এখনই উচিত এসব ছোট যানবাহনের নিবন্ধন দেয়া বন্ধ করা।