জ্বালানি আমদানির চাপ রিজার্ভে

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩, ১১:৩৯ পিএম
জ্বালানি আমদানির চাপ রিজার্ভে

দেশে রেকর্ড হারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার পর জ্বালানি সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাত হওয়ায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। পর্যাপ্ত ডলার মজুত না থাকায় এলএনজির বড় চালানও আমদানি করা যাচ্ছে না। কয়লা সংকটে ধুঁকছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ধারাবাহিকভাবে কমলেও নিয়মিত জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানিনির্ভর জ্বালানির দেশ হওয়ায় চাপ বেড়েই চলছে সরকারে। সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। 

সরকারি তথ্যমতে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে এক কোটি ৭৫ লাখ টনে। চলতি বছরের মার্চ থেকে আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত মেনে চলছে সরকার। সংস্থাটির পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি বছরের জুনে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকতে পারবে না। অথচ বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ২৩ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তা ২১ বিলিয়নের ঘরে নেমে যাবে। কারণ আগামী মাসে আকু পেমেন্ট বাবদ এক বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। গত বছর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) পেমেন্ট দুই বিলিয়নের কাছাকাছি থাকলেও আমদানি কমে যাওয়ায় বিগত কয়েক কিস্তিতে আকু পেমেন্ট সোয়া বিলিয়নের আশপাশে থাকছে। দুই মাস পরপর এশিয়ার দেশগুলোকে এ দায় পরিশোধ করতে হয়। সর্বশেষ গত ৬ জুলাই মে-জুন মাসের দায় বাবদ ১১০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে কারণে সংকট দেখা দিয়েছে, এখন তার উল্টো কাজ করতে হবে। স্বল্প অথবা দীর্ঘমেয়াদে গ্যাসের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে পারলে সংকট অনেকটা কেটে আসবে। মূল সমস্যা জ্বালানি। জ্বালানি কিনতে গিয়ে অন্য অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আরও বলেন, দেশীয় উৎস থেকে তেল-গ্যাস আহরণের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তা না করে আমদানি-নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। ডলার সংকট হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কলকারখানা চালু রাখতে হলে জ্বালানি আমদানি করতে হবে। এর বিকল্প নেই। সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এলএনজি আমদানি করা ভালো হবে। যত দ্রুত সম্ভব দেশীয় উৎস থেকে তেল-গ্যাস আহরণের দিকে জোর দিতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাই এই অবস্থায় আমদানি করার বিকল্প নেই। আমদানির সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প উপায়গুলো নিয়েও ভাবতে হবে বলে মনে করছেন তারা। তবে জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, চড়া দামের এলএনজি আমদানির কারণে সার্বিকভাবে উচ্চমূল্যের গ্যাসের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পক্ষান্তরে যার একটি নেতিবাচক প্রভাবই পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তীব্রভাবে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেভাবেই সরবরাহ হোক না কেন দাম সামর্থ্যের মধ্যে থাকতে হবে।

এই অবস্থার জন্য বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বললেও মোটা দাগে গ্যাস উৎপাদন ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। ধারাবাহিকভাবে গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় সরকার উচ্চমূল্যের এলএনজিতে নির্ভর করেছিল। এখন রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় উন্নত দেশগুলো এই এলএনজি কিনছে। তাদের সঙ্গে দামে পেরে উঠছে না বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারের যে অবস্থা তাতে এখন সরকারকে এলএনজি কিনতে হলে প্রায় সাতগুণ দাম দিতে হচ্ছে। 

এদিকে ডলার সংকটে জ্বালানি খাতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারায় সক্ষমতা সত্ত্বেও লোডশেডিং বেড়েছে। বিঘ্নিত হচ্ছে কলকারখানার উৎপাদন। ধুঁকছে ছোট বড় অনেক শিল্পকারখানা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভ ন্যূনতম ২৫ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা থাকলেও দেশে মজুত আছে ২১ বিলিয়ন ডলার। 

প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক  গ্যাস (এলএনজি) ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট কিন্তু উৎপাদন হয় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পেছনে। ঘাটতি মেটাতে ২০১০ সালে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেয় সরকার। ডলার সংকটের এমন মুহূর্তেও আমদানির বিপরীতে নিজস্ব উৎপাদনে তেমন তৎপরতা লক্ষণীয় নয়। দেশীয় উত্তোলন-অনুসন্ধানে জোর না দেয়ায় আগামী ১০ বছরেও নিজস্ব উৎস থেকে জ্বালানি সরবরাহ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। দেশে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা প্রয়োজন হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। দেশে সরবরাহকৃত গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ এবং কয়লা, জ্বালানি তেল ও এলপিজির প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। 

সূত্র জানায়, ২০২৬ সাল থেকে ১৫ বছর এলএনজি সরবরাহ করবে স্থানীয় সামিট গ্রুপ। বছরে এক থেকে দেড় মিলিয়ন (১০-১৫ লাখ টন) এলএনজি সরবরাহ করবে এক্সিলারেট এনার্জি। একইভাবে বছরে দেড় মিলিয়ন (১৫ লাখ) টন এলএনজি সরবরাহ করবে সামিট। নতুন তিনটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে কাতার ও ওমানের সঙ্গে এলএনজি সরবরাহ চুক্তি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বেসরকারি খাতে এলএনজি আমদানি নীতিমালা সংশোধন করা হবে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের মাধ্যমে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে দুটি কোম্পানির সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি করা হচ্ছে।  

এছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১টি কার্গো কেনার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বছরে ৫৬টি কার্গো আসে। অর্থের সংস্থান হলে স্পট মার্কেট থেকে আরও কয়েকটি কার্গো কেনা হবে। এতে ডলারের ওপর যেমন চাপ বাড়বে তেমনি উচ্চমূল্যে এলএনজি কেনার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, সরকার বিরাট আকারে এলএনজি আমদানির যে পরিকল্পনা করেছে, তা অর্থনীতিতে একটি বড় প্রভাব পড়বে। 

তিনি বলেন, এলএনজির বিকল্প বাংলাদেশের সামনেই ছিল। ২০১২ সালে মিয়ানমারের কাছ থেকে আমরা যে সমুদ্রসীমা জয় করেছি, অনুসন্ধান চালালে সেখানে নিয়মিত গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মিয়ানমার আমাদের বর্ডারের কাছেই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। অর্থাৎ পাশেই আমাদের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা ছিল। এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় স্বল্পমেয়াদে অল্প পরিমাণ আমদানি করা যেতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাপান, কোরিয়ার মতো উন্নত দেশগুলো এই আমদানির পরিকল্পনা করতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো দেশের জন্য এই বড় বাজেটের জ্বালানি আমদানি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সরকারের ভুল নীতির মাসুল জনগণের ওপর অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। জনগণের ওপর অন্যায়-অবিচার করা হচ্ছে। আমরা কেউ ভালো নেই। ভুল পরিকল্পনা এবং নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।