সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান

চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালনে ঈর্ষণীয় সাফল্য

নুর মোহাম্মদ মিঠু প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩, ১০:৩০ এএম
চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালনে ঈর্ষণীয় সাফল্য
  • নতুন দায়িত্বেও থাকছে একাধিক চ্যালেঞ্জ
  • ট্যুরিস্ট পুলিশে বহুমাত্রিক নতুনত্বের সংযোজন, 
  • গড়ে উঠছে টেকসই পর্যটনশিল্প

বহুমুখী চ্যালেঞ্জের বিপরীতে দায়িত্ব পালন করে সাফল্যের মুকুট ছিনিয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। বহু কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে যারা আজ সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছেন,  তাদেরই অন্যতম একজন বাংলাদেশ পুলিশের তারকা কর্মকর্তা অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান। সর্বশেষ থিতিয়ে যাওয়া ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান হিসেবে যিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর ইউনিটটিতে দিয়েছেন বহুমাত্রিক নতুনত্বের সংযোজন। আর মাত্র সপ্তাহখানেক পরই পুলিশের সবচেয়ে বড় এবং চ্যালেঞ্জিং ইউনিট ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজের সাফল্যের মুকুটে যুক্ত করতে যাচ্ছেন আরও একটি নতুন পালক। 

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, যে কোনো চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালনেই অনন্য সক্ষমতার হাবিবুর রহমানকে এই দায়িত্ব (ডিএমপি কমিশনার) গ্রহণের পরই মোকাবিলা করতে হবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ। এর বাইরেও নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই। তারা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও যখন দেশে জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি দিয়ে সাধারণ মানুষের জান-মালের ক্ষতি করা হচ্ছিল, দেশে যখন একরকম অচলাবস্থা বিরাজ করছিল, তখনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিরলস কাজ করেছিলেন তৎকালীন পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি প্রশাসন হিসেবে কর্মরত হাবিবুর রহমান। পুলিশের মেধাবী ও চৌকস কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পদে পদায়ন করে সে সময় তিনি দিয়েছিলেন নির্দেশনা; তাতেও তিনি সফল হয়েছিলেন। 

এরপর দায়িত্ব পান ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে নতুন ভাবনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে বাহিনীর উন্নয়ন, সদস্যদের পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধি, জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধন রচনা করে দেশসেবায় ব্রতী হয়েছেন। টাকা ছাড়া জিডি, পুলিশি সেবা মানুষের দোরগড়ায় নিয়ে যাওয়া, ঢাকায় বসে বিভাগের বিভিন্ন থানার কার্যক্রম মনিটরিং, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমনে বিট পুলিশিং কার্যক্রম জোরদারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ চালান। আর তাতেই মেলে সফলতা। থানা পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের গড়ে ওঠে সেতুবন্ধন। সে সময় দেশজুড়ে এমনও আওয়াজ উঠেছিল— পুলিশের অন্যসব ইউনিটের তুলনায় সেবায় ‘সেরা ঢাকা রেঞ্জ’। সংশ্লিষ্টরা এও বলছেন, দেশমাতৃকার সেবায় নিবেদিত এই কর্মকর্তা কর্মজীবনে এর আগে যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই তাকে ঘিরে স্বপ্ন বুনেছেন সবাই। দক্ষ, আধুনিক ও ভিশনারি পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তার সৃজনশীল নেতৃত্ব পুলিশ বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়িয়েছে বহুগুণ। এর অনন্য উদাহরণ হলো এক বছরেরও কম সময়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের বদলে দেয়া সার্বিক দৃশ্যপট। প্রণীত হয়েছে নতুন রূপরেখা। সেই রূপরেখা ধরেই টেকসই পর্যটনশিল্প গড়তে এখন কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।

ট্যুরিস্ট পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইউনিটটির দায়িত্ব গ্রহণের পরই সর্বপ্রথম ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যদের ট্রেনিং, কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, সদস্যদের আবাসন সংকট, আধুনিক কমান্ড কন্ট্রোল রুম স্থাপন এবং আধুনিক অফিস করেন তিনি। এরপর ট্যুরিস্টদের জন্য হেল্পলাইন, পর্যটন এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনাসহ বিভিন্ন পরিবর্তন আনেন। আর এতেই পেয়ে যান সফলতা। ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রতিষ্ঠার পর কার্যক্রম শুরু হয় মেরাদিয়ার তিনটি বিচ্ছিন্ন ভবনে। পরে সেখান থেকেই হাবিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টনের আধুনিক একটি ভবনে (ফারইস্ট টাওয়ার) ট্যুরিস্ট পুলিশের সদর দপ্তর স্থানান্তর করেন। এরপর আধুনিক কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করা হয়। যেখানে সার্বক্ষণিক ট্যুরিস্টদের সেবায় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া ট্যুরিস্ট হেল্পলাইনও চালু করা হয়। যার নম্বর ০১৩২০-২২২২২২ ও ০১৮৮৭-৮৭৮৭৮৭। এখানে ফোন করে পর্যটকরা যে কোনো অভিযোগ তুলে ধরতে পারেন। যাতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার ও কুয়াকাটার পর্যটকদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস ডেস্ক চালু করা হয়, যা ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাছাড়া কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় আগত পর্যটকদের নিরাপত্তায় সিসিটিভি স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে নাইট ভিশন, ফেস ডিটেকশন ক্যামেরা রয়েছে। এতে যে কোনো চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন পর্যটকরা। 

ট্যুরিস্ট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পর্যটন এলাকার দৃশ্য তুলে ধরে প্রচারণা চালায় ট্যুরিস্ট পুলিশ। এতে পর্যটন এলাকা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানতে পারছে। একসময় ট্যুরিস্ট পুলিশের ফেসবুক পেজে এক লাখেরও কম লাইক এবং দেড় লাখের কম ফলোয়ার ছিল। এখন লাইক দুই লাখ ৬৩ হাজার এবং ফলোয়ার তিন লাখের বেশি রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন পর্যটক স্পটে ঘুরে যাওয়ার পর দেশি-বিদেশি পর্যটক তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছেন।  

ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা বলছেন, মাঠে সদস্যরা যারা কাজ করেন, তাদের ডিউটি স্বাচ্ছন্দ্য করতে ভেস্ট ও ফিল্ড ক্যাপের প্রচলন করা হয়েছে। আর প্রতি মাসে ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যদের জন্য বড় খানার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অর্থ সংস্থান করেন হাবিবুর রহমান। এর বাইরে পর্যটন স্পটে যেসব স্টেকহোল্ডার আছেন, তাদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিয়ম সভা, ওয়ার্কশপ ও সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে। যাতে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবা নিশ্চিত করতে দেশের বিভিন্ন হোটেল-মোটেলে ট্যুরিস্ট পুলিশের হেল্প ডেক্স স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি ট্যুরিস্ট পুলিশের সব ইউনিটে ডি-নথির প্রশিক্ষণ ও ব্যবহার চলছে। বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ছাড়াও সমুদ্রসৈকতে সব পর্যটকের মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি-ছিনতাইয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তারে ব্যাপক সাঁড়াশি অভিযান চালায় ট্যুরিস্ট পুলিশ। এর বাইরেও এ বছর ঈদুল আজহার ছুটিতে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে নিখোঁজ ২১ শিশুকে উদ্ধার করেছে তারা। তাছাড়া সিলেট সীমান্তসহ বিভিন্ন এলাকার চোরাচালান ও জালনোট বাজারে ছড়িয়ে দেয়া ঠেকাতে কঠোর ভূমিকা রাখছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। আর  বাহিনীর এসব কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন হাবিবুর রহমান। 

মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন হাবিবুর রহমান। নিজ গ্রামের মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই তার প্রারম্ভিক শিক্ষাজীবন। এসএম মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৭তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে ১৯৯৮ সালে কর্মজীবন শুরু করেন। হাবিবুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেকে এনে মাত্র ১০০ টাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেন; যা নিয়ে তিনি অনন্য নজির স্থাপন করেন। সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে উচ্চ প্রশংসা পান। পেশায় পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হলেও সময় পেলেই কাছে টেনে নেন সুবিধাবঞ্চিতদের। পুলিশি সেবার বাইরে গিয়ে হাবিবুর রহমান মানবিক কাজ করতে সব সময় ভালোবাসেন। সমাজের পিছিয়েপড়া বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বদলে দিয়েছেন তিনি। কাজ করছেন যৌনপল্লীর শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে। শুধু তা-ই নয়, ভালো কাজ করতে সহযোগিতার পাশাপাশি দেন দিকনির্দেশনাও। এজন্য ‘মানবিক পুলিশ অফিসার’ হিসেবেও রয়েছে তার সুখ্যাতি।

লেখালেখির মতো সৃষ্টিশীল কর্মেও সমানভাবে সক্রিয় হাবিবুর রহমান। গত ৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চিঠিপত্র : শেখ মুজিবুর রহমান’ এবং একই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ ‘লেটারস অব শেখ মুজিবুর রহমান’-এর মোড়কও উন্মোচন করেন। এ বই দুটি সম্পাদনায় হাবিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. এনায়েত করিম। ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করেন। এর আগে হাবিবুর রহমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে ‘নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’ সম্পাদনা করেন। ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ নামে তার লেখা আরেকটি বইয়ে প্রথমবারের মতো বিস্তারিত উঠে আসে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা। ২০১৮ সালে প্রকাশিত বইটি সম্পাদনায় মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন হাবিবুর রহমান। 

এছাড়াও হাবিবুর রহমানের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ঠার’ বেশ আলোচিত। এ বইয়ে তিনি বেদে সম্প্রদায়ের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ওপর বই লিখেছেন হাবিবুর রহমান। ২০১৬ সালে তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরে পদায়িত হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির দায়িত্ব পান। দীর্ঘ তিন বছর তিন মাস দায়িত্ব পালন শেষে ঢাকা রেঞ্জকে সেবায় সেরা করে গত বছরের ১১ অক্টোবর ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব পালনে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এবার আগামী ১ অক্টোবর তিনি গ্রহণ করবেন ডিএমপি প্রধানের দায়িত্বও।