বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্ররা সরকার ফেলে দিতে চায়। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর এই চাওয়া-পাওয়া পূরণে হাতে আর মাত্র কয়েক দিন সময় আছে তাদের। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলও রাজপথে পাহারায় থাকছে, যাতে নতুন কিছু না ঘটে। আগামী একটি মাস বিরোধী দলগুলোকে মোকাবিলা করবে যাতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা না আসে।
তবে বিশ্লেষকরা একটি নতুন ভাবনার কথা বলছেন, অতীতে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ভূমিকা নিয়েছিল, সামনের দিনগুলোতে ঠিক এই ভূমিকায় পাওয়া যাবে না কি-না তা নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে, এ কারণে স্যাংশন। ভিসানীতির কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। নাটকীয় কিছু না ঘটলে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করতে চায় নির্বাচন কমিশন-ইসি। সে ক্ষেত্রে ভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে ডিসেম্বরের শেষ অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজপথে অবস্থান করছে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা। তারা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে রাজপথে সক্রিয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই তারা তাদের আন্দোলনকে যৌক্তির পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাবে। দীর্ঘদিন মাঠে থেকে বিরোধী দলগুলো যে দাবি আদায়ে সংগ্রাম করছে তার ফল তোলার সময় এখনই, এমনটিই মনে করছেন বিরোধী দলের নেতারা।
দলগুলো এটি মাথায় রেখেই নানা পরিকল্পনা করছে, করছে নানা কৌশল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, তফসিল ঘোষণা হলে যেকোনো মূল্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তফসিলের মাত্র এক মাস বাকি আছে, আর এই এক মাস বিরোধী দলগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে সফলভাবে— যাতে দেশে-বিদেশে সমালোচনা না হয় সে জন্য ক্ষমতাসীন দলটি বিরোধী দলগুলোতে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। পাশাপাশি জনগণের দৃষ্টি সরকারের দিকে ফেরাতে বেশ কিছু শোডাউন করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। বিশেষ করে ঢাকায় সমাবেশ, বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন ও একই সঙ্গে সুধীসমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপিও অক্টোবরে চূড়ান্ত সফলতায় পৌঁছতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছে। বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, সব সময় ঘোষণা দিয়ে করা কর্মসূচি থেকে আন্দোলনের সফলতা আসবে এমন কথা নেই। মাঠে তৎপরতার চলতে থাকলে মাঠ থেকেই নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি ও নতুন কৌশল অবিষ্কার হয়ে যায়, সে কারণে দেশ কোনো পথে যাচ্ছে তা জানতে ও বুঝতে জনগণকে আর খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
আওয়ামী লীগ রাজপথে নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখতে ও জনগণের দৃষ্টি সরকারের দিকে ইতিবাচক করতে ইতোমধ্যে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গতকাল রোববার দলটির সাধারণ সম্পাদক এ কর্মসূচি ঘোষণা দেন। এর আগে গতকাল বিকেলে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে দলটির ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ মহানগর, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর মহানগর এবং ঢাকা জেলা ও পার্শ্ববর্তী জেলা নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার নেতারা বিশেষ যৌথসভা করেছেন। ওই সভা থেকেই নতুন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত আসে। অক্টোবর মাসজুড়ে টানা এ কর্মসূচি পালন করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে— ৩ অক্টোবর সাভারের আমিন বাজারে মহাসমাবেশ; ৭ অক্টোবর বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন; ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতুর রেল সেতু উদ্বোধন; ২৩ অক্টোবর মেট্রোরেলের মতিঝিল অংশ উদ্বোধন ও ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ সুধীসমাবেশ।
এদিকে বিএনপি ১৫ দিনের যে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিল তাতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে দলটি। প্রথমে ঘোষিত কর্মসূচি ৩ অক্টোবর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে তা ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, গতকাল ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জে রোডমার্চ করে বিএনপি। আজ ২ অক্টোবর ঢাকায় কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ৩ অক্টোবর ফরিদপুর বিভাগে রোডমার্চ ও সমাবেশ। ৪ অক্টোবর ঢাকায় পেশাজীবী কনভেনশন। ৫ অক্টোবর কুমিল্লা, ফেনী, মিরসরাই হয়ে চট্টগ্রামে রোডমার্চ। অন্যদিকে ৪ অক্টোবর মিরসরাইয়ে সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। পূর্বে ঘোষতি কর্মসূচি চলমান থাকাকালেই আওয়ামী লীগ পুরো অক্টোবর মাসব্যাপী নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি শেষ হচ্ছে ৫ অক্টোবর। এরই মধ্যে বিএনপি ও তার মিত্ররা নতুন করে কর্মসূচি গ্রহণ করবে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচিতে রাজধানীসহ সারা দেশ থাকবে উত্তাল। বিএনপিসহ রাজপথে থাকা বিরোধী দলগুলোর কাছে প্রধান ইস্যু নির্বাচনকালীন সরকার। এদিকে বিরোধী দলগুলোকে বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা নিয়েও রাজপথে দেখা যেতে পারে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে দলটির সিনিয়র নেতারা সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আল্টিমেটাম শেষ হয়ে বেশ কয়েক দিন আগেই। এরই মধ্যে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে মর্মে খবর বের হয়, কিন্তু গতকাল আইনমন্ত্রী যখন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তাকে চিকিৎসা দিতে কেন বিদেশে পাঠানো যাচ্ছে না, তখন এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে নতুন করে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীয় ইস্যুতে অনমনীয় উভয় পক্ষ। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি বন্ধুরা আমাদের সমস্যা সমাধান করে দেবে না। তারা পথ দেখিয়ে দিতে পারে। সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। সে ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ থেকে নমনীয় হয়ে এক টেবিলে আসতে হবে, বসতে হবে। কিন্তু সে ধরনের কোনো লক্ষণ দেখছেন না তারা। খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হলে সেটিতে রাজনীতিতে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু তার সম্ভাবনাও এখন আর নেই। ফলে নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই বিরোধী ঠিক কোন পথে মিঠবে তা অনেকটাই অনিশ্চিত।
সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হতে বেশি সময় লাগবে না, কয়েক দিনের মধ্যেই নির্ধারিত হয়ে যাবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকবে কি-না, গণতান্ত্রিক অধিকার থাকবে কি-না, জনগণ তার প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে কি-না, এসবই নির্ধারিত হয়ে যাবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে। এর আগে বিএনপি মহাসচিব এ-ও বলেছেন, সরকার কথা না শুনলে রাজপথেই ফয়সালা হবে। প্রায় একই সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ৩৬ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন বিএনপিকে। তিনি বলেছেন, আগামী ৩৬ দিন বিএনপিকে দাঁড়াতে দেবে না তার দল। সব জায়গা বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের দখলে থাকবে।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল বসে সংলাপ করে বিরোধ নিষ্পত্তি করা উচিত, তা না হলে পরিণতি শুভ হবে না। দেশ এক অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।’