শর্ত পূরণ না হওয়ায় শ্রীলঙ্কার কিস্তি স্থগিত করল আইএমএফ
- লাগামহীন খেলাপি ঋণ, ঊর্ধ্ব মূলস্ফীতি ও ডলার বাজারের অস্থিরতায় বিপাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
- রাজস্ব ও রিজার্ভ প্রশ্নে ছাড় দিতে নারাজ মিশন সদস্যরা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচিতে আরোপিত শর্ত পূরণ না হওয়ায় দ্বিতীয় কিস্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়েই চলেছে। পর্যাপ্ত রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শর্তানুযায়ী খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলা হলেও উল্টো বেড়েছে। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এ ছাড়া ঋণের সুদহার, ডলার বাজার ও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজমান। এর সঙ্গে বাড়তি শঙ্কা তৈরি করেছে শ্রীলঙ্কার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি স্থগিত হওয়ার খবর। রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণ দেখিয়ে দেশটির ঋণ আটকে দিয়েছে আইএমএফ। বার্তা সংস্থা এএফপি এ তথ্য জানিয়েছে।
বাংলাদেশকে দেয়া ঋণ প্রতিশ্রুতির দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে শর্ত পর্যালোচনা করতে আইএমএফ প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় দিনের মতো গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন মিশন সদস্যরা। তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সংস্থাটির চাপের মুখে নীতি সুদহার ও ঋণের সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা। এর আগে গত বুধবার প্রথম দিনের বৈঠকে রিজার্ভের অপর্যাপ্ততা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আইএমএফ মিশন। একই সঙ্গে লাগামহীন খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক ব্যবস্থার সুশাসন নিশ্চিতে ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা দাবি করা হয়েছে। ঋণের শর্ত অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার মজুত রাখার কথা ছিল। কিন্তু বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ আছে মাত্র ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আর নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ রয়েছে ১৮ বিলিয়নের নিচে। এ ছাড়া শর্ত ছিল সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে থাকতে হবে। কিন্তু এ শর্তও পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রয়েছে ২৫ দশমিক ০১ শতাংশ।
অন্যদিকে রাজস্ব আহরণের কাঙ্ক্ষিত শর্তও পূরণ করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে তিন লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয় আইএমএফ। আলোচ্য সময়ে এনবিআর রাজস্ব আহরণ করেছে তিন লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। জানা গেছে, রাজস্ব ও রিজার্ভের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ দেশকে ঋণ ছাড় করে না আইএমএফ। একই কারণে শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ঋণ প্রতিশ্রুতি স্থগিত করেছে সংস্থাটি। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা নীতি সুদহার ১০০ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত আসার আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ আটকে দেয়। ঋণের কিছু শর্ত সরকার পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কিস্তির অর্থছাড় স্থগিত হয়ে গেছে।
এএফপি জানায়, শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, তাদের প্রধান সুদের হার কমিয়ে ১১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির হার গত মাসে দ্রুত কমে ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এক বছর আগে মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল ৭০ শতাংশ। গত মার্চ মাসে আইএমএফের সঙ্গে কলম্বোর সরকার ২৯০ কোটি ডলারের একটি ঋণ চুক্তিতে পৌঁছায়। চার বছর মেয়াদে এই অর্থ ছাড় করার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় কিস্তির ৩৩ কোটি ডলারই সরকার হাতে পায়নি। এরপর কর্তৃপক্ষ নীতি সুদহার কমানোর সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে। আইএমএফ এরই মধ্যে তাদের ঋণ কর্মসূচির প্রথম পর্যালোচনা শেষ করেছে। সে কারণে সরকার আশা করেছিল যে, গত মাসেই দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করা হবে। তবে আইএমএফ মতামত দিয়েছে, সরকার শর্তানুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। এর জন্য দেশটিকে আরও কর আদায় করতে হবে বলে আইএমএফ মনে করে।
উল্লেখ্য, আইএমএফ চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিন দিন পর প্রথম কিস্তিতে ছাড় করে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৭০ কোটি ডলার ছাড় করার কথা রয়েছে। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে তাদের দেয়া শর্ত বাস্তবায়নের অর্থগতি পর্যবেক্ষণেই ঢাকায় আসছে আইএমএফ মিশন। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে পুরো অর্থ দেয়ার কথা আইএমএফের। এই ঋণ নিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। এসব শর্ত পূরণে ব্যর্থতার কারণে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।