- ব্যানারসর্বস্ব ও ভুঁইফোঁড় দলে মন ভাঙল বিএনপির এখন মনোযোগী ধর্মীয় দলে
- বিএনপির দুঃসময়ের কারণ চিহ্নিত, ছাত্ররাজনীতির নেতাদের নিয়ে নতুন
- ছক সরকারবিরোধী যাদের রাজনৈতিক ভিত্তি ও শক্তি রয়েছে, তারাই থাকবে ফ্রন্টলাইনে
- বিএনপি জামায়াতকে সামনে চাচ্ছে, দলটির আগ্রহ এক ব্যানারে আন্দোলন
জামায়াতকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, কারণ তারা বিরোধী রাজনৈতিক দল
—রুহুল কবির রিজভী
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি
জামায়াত সদস্যরা দেশের বৈধ নাগরিক, তারা সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন
—ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ
প্রেসিডেন্ট, এলডিপি
নিবন্ধন নিয়ে আইনজীবীরা কাজ করছেন, আমরা সরকার পতনে মনোযোগী
—মাওলানা আবদুল হালিম
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল. জামায়াত
না পেছালেও তাদের দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন চলতে থাকবে। ধর্মীয় দলগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে, বিশেষ করে জামায়াতের বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছে বিএনপি। সম্প্রতি দলটির হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। একই বিষয়ে বিএনপি জোটের অন্য শরিকরাও কথা বলেছে।
বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পতনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। ২০১৪-১৮ সালের মতো তারা এ দেশে আর নির্বাচন হতে দেবে না। ৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে ভোট উৎসবের এই সময়ে বিএনপি-জামায়াত কার্যালয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তালা ঝুলছে। চালানো হচ্ছে গণগ্রেপ্তার। মাঠ পর্যায়ের নেতাদের দেয়া হচ্ছে সাজা। এমন পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। অতীতেও সরকার বি. চৌধুরী-মান্নান ভূঁইয়াসহ একাধিকজনের মাধ্যমে বহুবার দল ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছে কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। এবারও সেরকম একটি দৃশ্যপট চলছে।
তারা মনে করছে, মৌলিক কোনো ব্যক্তি এবার সরকারের ফাঁদে পা দেবে না। এর মধ্যে যারা বিভিন্ন পন্থি-গোষ্ঠীর, ছাত্ররাজনীতির আদর্শ নেই, তাদের কেউ কেউ দলছুট হয়ে যেতে পারে। কারা যাচ্ছে, কতজন দলছুট হচ্ছে— এ বিষয়গুলো ভালোভাবে জেনে তারা সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দেবে। তখন যাদের মৌলিক রাজনৈতিক ভিত্তি ও শক্তি রয়েছে, তারাই থাকবে ফ্রন্টলাইনে। এর মধ্যে জামায়াতকে আন্দোলন বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বিএনপি। একইসঙ্গে অন্য ইসলামিক দলগুলোর প্রয়োজনীয়তাও বিএনপির ঘরে রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনও ইতোমধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এই সরকারের অধীনে আর নির্বাচনে যাবে না। খেলাফত মজলিসসহ কিছু বামপন্থি দলও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। যারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনে থাকবে, তাদেরকেই পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে।
জামায়াত আসলে কী করতে চাচ্ছে? দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটির সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সফল আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে তারা রাজপথে নামবে। যদিও সরকার তফসিল ঘোষণা করে আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ ঘোষণা রয়েছে। তারা মনে করছে, সরকার আর অতীতের মতো নির্বাচন করতে পারবে না। বিএনপিসহ সব বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বিদায় নিতে হবে। তৃণমূল পর্যায়েও আন্দোলনের বার্তা দিয়েছে দলটি। ঢাকাসহ সারা দেশেই তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল নিয়ে গতকাল কর্মসূচি পালন করেছে। এছাড়া হরতাল-অবরোধেও তারা সক্রিয়ভাবে মাঠে রয়েছে। দলটির প্রচার বিভাগ বলছে, আওয়ামী সরকার কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে। ২৫ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত গুপ্ত হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন। হামলার শিকার হয়েছেন ১৯ জন। আহত হয়েছেন ৪২০ জন। গুলিবিদ্ধ হয়ে শঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন দুজন। গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই হাজার ৩৭৭ জন। এছাড়া গত ১৫ বছরে তাদের লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সরকারের আমলে ২৪৯ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। প্রায় ৯৭ হাজার নেতাকর্মীকে বিভিন্নভাবে আটক করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার নেতাকর্মীকে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে বলেও দাবি দলটির।
দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বিএনপির বড় অংশই এখন জামায়াতকে সামনের সারিতে আন্দোনে চাচ্ছে। জামায়াতও দেশের এই কঠিন সময়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, সুশাসন ও দেশের নাগরিকদের খেয়েপরে বেঁচে থাকা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে রাগ-অভিমান সবকিছু ভুলে আন্দোলনে মনোযোগী। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনে কোনো ফলাফল আসছে না। তারা মনে করছে, এক ব্যানারে আন্দোলন হলে সরকার চলে যেতে বাধ্য হবে। জামায়াতে ইসলামী সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে মাঠে নামবে। দলটির নির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন— দেখুন, এখন আমরা আমাদের মতো করে আন্দোলন করছি, বিএনপি করছে তাদের মতো করে। এখন আমরা যদি বড় মুভমেন্টে যাই, তখন বিএনপির একাংশ হয়তো আন্দোলনের দায় নেবে না। সব হিসাব ভুলে যদি দেশের সব ইসলামি দলগুলোকে বিএনপি এক ব্যানারে ডাক দেয়, তাহলে এই সরকার নির্বাচনের আগেই সরে যেতে বাধ্য হবে। আর যদি নির্বাচন করেও সব দলকে নিয়ে যদি আন্দোলন করে, তাহলেও আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। দেশের এই পরিস্থিতিতে এখন বিএনপিকেই বড় উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও বিএনপি এখন জামায়াতসহ সবাইকে সামনে চাচ্ছে, সেই ম্যাসেজ আমাদের কাছে রয়েছে। আমরাও দেশের এই স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে থাকব।
এ নিয়ে জানতে চাইলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বীর বিক্রম আমার সংবাদকে বলেন, সরকার এখন বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আটক করছে। ধরেই সাজা দিয়ে দিচ্ছে। এগুলো যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, তা সবার কাছেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। আমরা সম্প্রতি দেখেছি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে, তারা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক। সুতরাং তাদের রাজনীতি করার, রাজনৈতিক দল করার এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করি। কিন্তু এখন তারা সুবিচার হতে বঞ্চিত হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যে আপিল করা হয়েছিল, তাও খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। তিনি বলেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে অন্যায় রায় দিয়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তবে জনগণ এ রায়ে বিস্মিত হয়নি। তারা ন্যায়বিচারের শেষ অবলম্বন বিচার বিভাগের ব্যক্তিদের রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট বক্তব্য এবং সরকারের ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করার ঘটনায় হতাশ হয়েছে। রিজভী আরও বলেন, যে কোনো বিরোধী দল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগ কর্তৃক তার গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার যোগ্য। এর কোনো ব্যতিক্রম গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। আর এ ধরনের রায়ও অগ্রহণযোগ্য।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম আমার সংবাদকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। ইউনিয়ন থেকে সংসদ সদস্য পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। দলটির শত শত নেতাকর্মী জনকল্যাণমুখী নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। আগামীতেও জামায়াত জনগণের সমর্থন নিয়ে রাজনীতি করবে। জামায়াতে ইসলামী এখন অগণতান্ত্রিক সরকার পতনের দিকে মনোযোগী। দলীয় সরকারের অধীনে দেশের কল্যাণ চায়— এমন কেউ নির্বাচনে যাবে না। জামায়াতে ইসলামীও এ সরকারের অধীনে অন্য কোনো দলের মাধ্যমে নির্বাচনে যাবে না।
দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি আইনগতভাবে মোকাবিলা করব। আমাদের আইনজীবীরা এ নিয়ে কাজ করছেন। এছাড়া রাজনৈতিক ভূমিকার নিয়েও আমরা চিন্তা করছি। আপনারা জানেন, সরকারের পক্ষে যে ব্যক্তিটি ছিলেন— ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, তিনি সরকারের অনুগত লোক। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি তিনি কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এ থেকে বিষয়টি প্রমাণিত হয় সরকার আদালতের মাধ্যমে দলীয় লোক দিয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। তিনি আরও বলেন, সরকার এখন এতটাই আতঙ্কিত যে, জামায়াত-বিএনপিসহ বিরোধী সব নেতাকে আটক করেই সাজা দিয়ে দিচ্ছে। যাতে কেউ সহসাই নির্বাচনে যেতে না পারেন। এগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন মামলায় রায়ের প্রতিবাদে গতকাল সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আপিলকারী হিসেবে বক্তব্য শোনার সুযোগ না দিয়ে মামলাটি ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ করে দেয়ায় জামায়াতে ইসলামী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর ১৫-২০ শতাংশ ভোটার রয়েছেন। গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় জামায়াত আপসহীন। জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ অব্যাহত রাখবে। আমাদের মিটিং-মিছিল ও সমাবেশ করার ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বাধা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।