- সমঝোতায় রাজি হলে পেছানো হবে তফসিল— এমন বার্তা বিএনপির ঘরে
- নির্বাচনে গিয়ে আ.লীগকে বৈধতা দিলে ভাঙবে দল, রয়েছে এমন পর্যবেক্ষণ
- দলছুট ৬০-৭০ নেতাকে প্রার্থী বানাতে চায় সরকার, দাবি বিএনপির
প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে কোনো সমঝোতার প্রশ্নই উঠে না, আমরা দেখি কত নির্যাতন করতে পারে
—বেগম সেলিমা রহমান
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
এ নির্বাচনে নিঃসন্দেহে বিএনপি ও অন্য বর্জনকারী দলের কর্মীরা ভোট দিতে আগ্রহী হবেন না
—ড . বদিউল আলম মজুমদার সুজন সম্পাদক
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক অনেক চাপ আসা সত্ত্বেও নমনীয় নয় দলটি। বিএনপি বলছে, তাদের শীর্ষ নেতাদের আটক করেই উদ্দেশ্যেপ্রণোদিতভাবে সাজা দেয়া হচ্ছে। একের পর মামলা দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই শত শত নেতাকর্মীকে আটক করা হচ্ছে। আদালতের মাধ্যমেও মুক্তি মিলছে না। এ ছাড়া নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা হুমকি দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতা হবে না। সরকার নির্যাতনের মাত্রা কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে তারা দেখতে চান বলেও দাবি তুলেছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান এ বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেখুন সরকার একের পর এক লাশ ফেলছে। হেলমেট বাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমাদের বিরুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছে। আমরা খবর পাচ্ছি যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে। যাতে নির্বাচনের আগে কেউ ঘরে না থাকে। আমাদের দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। কেউ গেলেই তাকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একটি যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কোনো চাপে বা সরকারের আহ্বানে সাড়া দেবো না। প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে কোনো সমঝোতা প্রশ্নই উঠে না। আমরা দেখি সরকার কত লাশ ফেলতে পারে, কত নির্যাতন করতে পারে। এই সরকারের সঙ্গে আর নির্বাচন ও সমঝোতা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
যুগপৎ আন্দোলনের জোট ছেড়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেলিমা রহমান বলেন, ‘মেজর ইবরাহিমকে হয়তো সরকার চাপ দিয়েছে। তিনি চাপ সহ্য করতে না পেরে নতুন জোট গঠন করেছে। এগুলো জনগণের কাছে কোনো মূল্য নেই।’ রাজনৈতিক সূত্রগূলো বলছে, আর মাত্র দেড় মাস বাকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের। এখনো হয়নি নির্বাচনি সমঝোতা। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনেক আশঙ্কায় রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পরও চলছে সরকারবিরোধীদের ধারাবাহিক সিরিজ আন্দোলন। বিএনপি-জামায়াত, ইসলামপন্থি, বামপন্থিসহ অন্তত অর্ধশত দল এখনো নির্বাচনের বাইরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাও অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশে। দেশের অর্থনৈতিক সেক্টর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ এবার বাংলাদেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক টেবিলে বসার দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। চলমান পরিস্থিতিতে সংলাপ কিংবা আলোচনার দরজা খুলতে পারে এমনও সম্ভাবনা দেখছেন না রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। রাজনীতিতে অনেক অন্ধকার সময় অপেক্ষা করছে বলেও অনেকে মন্তব্য করছেন। বিএনপি জামায়াত নির্বাচনে না গেলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সারা দুনিয়ার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন চাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বিএনপই যাতে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। বিএনপি যদি পর্দার আড়ালে সমঝোতায় রাজি হয় প্রয়োজনে ১৫ থেকে ২০ দিন পিছিয়ে পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হবে। এমন ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে। গতকাল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, কমিশন যদি মনে করে তাহলে সংবিধানের ভেতর থেকে তফসিল পেছাতে পারে। তবে বিএনপি বলছে, এবার বিএনপি নির্বাচনে যাওয়া মানে একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো আবারো সরকারকে পাঁচ বছরের জন্য বৈধতা দেয়া। এখন নেতাকর্মীরা সরকারবিরোধী মনোভাব নিয়ে উজ্জীবিত। বিএনপি যদি সরকারের কোনো ফাঁদে পা দেয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যায় তখন দলের মধ্যে ভাঙন তৈরি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, পর্দার আড়ালে সরকার ও বিশেষ মহল থেকে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। বিএনপি যদি সমঝোতায় আসে তাহলে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সংবিধানের ভেতর থেকে দুই-তিন মাস নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হবে। এরপর পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হবে, দলে এখন যে হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা হচ্ছে সেগুলো শীতল হবে। শীর্ষ নেতাদের মামলা প্রত্যাহারও হবে। যারা বন্দি রয়েছেন তারা মুক্তি পাবেন। নির্বাচনি প্রচারে নামলে দলের কোনো নেতাকর্মীদের বাধা দেয়া হবে না। বিএনপি যতটা দুঃসময়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ তার চাইতেও বেশি চ্যালেঞ্জিং সময়ে রয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে নিয়ে আসা। এমন পরিস্থিতিতে নানা মহল থেকে চাপের ফলেও বিএনপি অতীতের মতো ভুল পথে এবার পা দিচ্ছে না। দলটির নেতাকর্মী বলছেন, বিএনপি সরকারের ডাকে সাড়া না দেয়া দলের শীর্ষ নেতাদের আটক করে দ্রুত গতিতে সাজা দেয়া হচ্ছে। গতকাল দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামিন পাওয়া বড় সম্ভাবনা থাকলেও সমঝোতার পথ রুদ্ধ হওয়ায় ২৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় দলের মহাসচিবের জামিন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। দল ভাঙনের সতর্ক অবস্থান থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকেই দৃষ্টি রাখছে বিএনপি।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বিএনপি ভাঙনের চেষ্টায় ক্ষমতাসীনরা সফল না হওয়ায় এবার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। এবার তারা গ্রেপ্তার, অভিমানী, পদবঞ্চিত, প্রবীণ, ছাত্ররাজনীতির দলীয় ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা এবং সংসদ সদস্য হওয়ার অতি আগ্রহী তরুণ নেতাদের টার্গেট করেছে। এ সংখ্যা খুবই ছোট। ৬০ থেকে ৭০ জন নেতা এ তালিকায় রয়েছে। ৪০ থেকে ৪৫ জনকে প্রার্থী বানানোর জোর চেষ্টা চালানো চলছে। পাশাপাশি বিএনপির সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। ২০০৭ সালের এক-এগারোর সময়কার দলের সংস্কারপন্থি অংশটির সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এসব কিছু নিয়ে বিএনপি এবার চিন্তিত নয়। তারা বলছেন, মান্নান ভুঁইয়া, বি. চৌধুরীসহ অনেককে দিয়েই দল ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়েছে সফল হয়নি এবারও হবে না। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ইবরাহিমের মতো কেউ দলছুট হলেও বিএনপির ঘরে এবার এসব নিয়ে ভাবনা নেই। তারা কোনো ধরনের সমঝোতায় না গিয়ে ধারবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের টার্গেটকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।
রাজনৈতির সমঝোতা ও সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেখুন জনগণ আবারো তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই এখন বলা যায়। এ নির্বাচনে নিঃসন্দেহে বিএনপি ও অন্যান্য বর্জনকারী দলের কর্মী-সমর্থকরা ভোট দিতে আগ্রহী হবেন না। সমঝোতার পথও দেখা যাচ্ছে না। যদিও ভোটাধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি মানবাধিকার। তাই আগামী নির্বাচনে জনগণ তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, যেকোনো মূল্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আরেকটি পরিণতি হবে অর্থনৈতিক ধস, যার প্রভাব সাধারণ জনগণ ইতোমধ্যেই হারে হারে অনুভব করছে। আরেকটি একতরফা নির্বাচনের পথ থেকে সরে না এলে এর পরিণতি আরও খারাপ হতে পারে। আমরা দেখেছি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। যা অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক ছিল না।