ঢাকা সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ
রাজধানী ঢাকায় ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে নিবন্ধন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এসব গাড়ির ইকোনমি লাইফ (আয়ুষ্কাল) ধরা হয় ১৫ বছর। এরপর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে সিএনজি অটোরিকশাগুলো। মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে এসব গাড়ি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ধাপে ধাপে স্ক্র্যাপ (ভাঙা) করা শুরু করে বিআরটিএ।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ সব সিএনজি অটোরিকশা স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। এসব স্ক্র্যাপ করা সিএনজি অটোরিকশার মালিকদের নতুন করে আবার রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয় বিআরটিএ থেকে। ২০০১ থেকে ২০০৭ মডেলের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার সিএনজি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এসব সিএনজি অটোরিকশার স্ক্র্যাপ, প্রতিস্থাপন ও মেয়াদ বাড়ানোর নাম করে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের যোগসাজশে বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তা ও মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের বিরুদ্ধে ১১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) হওয়া একটি অভিযোগ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। দুদকে ওই অভিযোগটি দাখিল করেন ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সিএনজি অটোরিকশা প্রতিস্থাপনে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ঐক্য পরিষদ ও বিআরটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রতি গাড়ির স্ক্র্যাপ বাবদ ৩০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত সাধারণ মালিকদের জিম্মি করে ঘুষ নেয়া হয়েছে। তবে স্ক্র্যাপ বাবদ কোনো টাকা দিতে হয় না বলে জানান সিএনজি অটোরিকশার মালিকরা।
দুদকে জমা দেয়া অভিযোগে আরও বলা হয়, বিআরটিএর বিজ্ঞপ্তিতে স্ক্র্যাপ করা সিএনজি অটোরিকশার ভাঙা অংশ মালিকদের নিজ উদ্যোগে অপসারণ করার কথা বলা থাকলেও মালিকদের তা করতে দেয়া হয়নি। বরং বিআরটিএ ও ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু ও সচিব এটিএম নাজমুল হাসান স্ক্র্যাপকৃত সিএনজি অটোরিকশাগুলো ১০ হাজার টাকা করে বিক্রি করে দেন। স্ক্র্যাপকৃত সিএনজি অটোরিকশাগুলো নতুন করে আবার রেজিস্ট্রেশন করতেও ব্যাংকে প্রায় ১৪ হাজার টাকা ফি জমা দেয়ার পরও বিআরটিএর অসাধু চক্র মালিক প্রতি অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়াও অভিযোগে আরও বলা হয়, রেজিস্ট্রেশন ও স্ক্র্যাপের ব্যাপারে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অসাধু চক্র তাদের ঘনিষ্ঠ সহচরদের দালাল হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে। এই দালাল চক্র গাড়ি স্ক্র্যাপ ও রেজিস্ট্রেশনের ঘুষের টাকা কালেকশন করে মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের শীর্ষ নেতাদের হাতে তুলে দিতেন। মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের নেতাদের একটি অংশ বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তাদের মধ্যে লেনদেনও করতেন। বাকি অর্থ দালালসহ তাদের নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন। বিআরটিএর উৎকোচ বাণিজ্যের সব টাকা মেট্রো সার্কেল-১-এ ১৬ বছর ধরে কর্মরত হিসাবরক্ষক খান মোহাম্মদ রুহুল আমিন তদারকি করেন।
দুদকে অভিযোগকারী ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন আমার সংবাদকে বলেন, সমপ্রতি খান মোহাম্মদ রুহুল আমিন পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি আগে নতুন-পুরোনো লাইসেন্স, মালিকানা বদলি ও রোড পারমিটের কাজ করতেন। ওই পদে থাকা অবস্থায় ২০১৬-১৭ সালে ঢাকার সিএনজি-অটোরিকশার মেয়াদ ১৫ বছর থেকে ২০ বছর বাড়িয়ে দেবেন বলে ১৩ হাজার সিএনজি-অটোরিকশা মালিকদের কাছ থেকে টাকা নেন। এক হাজার টাকা করে পাঁচবারে টাকা নেন তিনি। ২০১৬ ও ২০১৭ সালের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এ নিয়ে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। খান মোহাম্মদ রুহুল আমিনের বদলির জন্য আবেদন করেও লাভ হয়নি জানিয়ে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বলেন, খান মোহাম্মদ রুহুল আমিনের বদলির জন্য গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বরাবর অভিযোগ করা হয়। তার পরেও রুহুল আমিন বহাল তবিয়তে থেকে বিআরটিএ অফিসে দালালদের মাধ্যমে ঘুষ বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছে।
হানিফ খোকন বলেন, সাড়ে ১২ হাজার সিএনজি অটোরিকশা স্ক্র্যাপ বাবদ গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে ৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, রেজিস্ট্রেশন বাবদ ২৫ হাজার টাকা করে ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং গাড়ির ভাঙা অংশ বিক্রি বাবদ ১০ হাজার টাকা করে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, মোট ১০৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা দুর্নীতি করা হয়েছে। সিএনজি অটোরিকশার মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানোর জন্য ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আমরা দুদকে অভিযোগ জানিয়েছি। আশা করছি দুদক এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখলে সব প্রমাণ পাবে। তারা কীভাবে কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু আমার সংবাদকে বলেন, ‘এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভুয়া ও ভিত্তিহীন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সিএনজি অটোরিকশার প্রতিস্থাপন দেয় বিআরটিএ। আর আমাদের (সংগঠনের) লাইসেন্স দেয়া হয়েছে মালিকদের স্বার্থ দেখার জন্য। এ ক্ষেত্রে সিএনজি অটোরিকশার মেয়াদোত্তীর্ণ হলে আমরা মন্ত্রণালয়ের আবেদন করি। সরকারের সাথে বসে প্রতিস্থাপন করি। এ কার্যক্রমের জন্য সাত সদস্যের কমিটি রয়েছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটও রয়েছে। তারা বসে তারিখ নির্ধারণ করে, আমরা গাড়ি হাজির করি এরপর ভাঙা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটসহ কমিটির অন্য সদস্যদের উপস্থিতিতে সেখানে কারো কিছুই করার সুযোগ নেই।’ হানিফ খোকনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তিনি শ্রমিক সংগঠনের নেতা, শ্রমিকদের স্বার্থ দেখবেন তিনি। মালিকদের বিষয়ে কিছু আছে বলে মনে করি না। এ ছাড়া আমরাই একমাত্র সংগঠন যেকোনো রকমের চাঁদাবাজিই আমরা করি না।
তবে ওসমান গনি নামে এক ভুক্তোভোগী সিএনজি মালিক আমার সংবাদকে বলেন, ২০১৯ সালে যখন আমার গাড়ি ভাঙা হয়, সে সময় প্রতিস্থাপনের জন্য বিআরটিএর ইকুরিয়া কার্যালয়ে আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেছিলেন বরকত উল্লাহ ভুলু। তখন মালিক সমিতিরই আরেক নেতা (সাধারণ সম্পাদক) হাসান ১০ হাজার টাকা কমিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত কিস্তি তুলে সেই টাকা দিতে হয়েছে। তবে গাড়ি ভাঙার পর ১০ হাজার টাকা দেয়ার কথা ছিল সেটিও দেয়নি, গাড়িও ফেরত পাইনি। জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, বরকত উল্লাহ ভুলুর লোকেরা থাকে তারা টাকা আদায় করে। এটি শুধু আমার ক্ষেত্রেই না, অন্য মালিকদের সঙ্গেও হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে খান মোহাম্মদ রুহুল আমিন আমার সংবাদকে বলেন, ২০১৬-১৭ সালে আমি লাইসেন্স আবেদন জমা নেয়ার দায়িত্বে ছিলাম। সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে কী হয়েছে তা আমি জানি না। হিসাবরক্ষকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় উৎকোচ গ্রহণ করতেন জানিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। তবে এমন কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। তিনি বলেন, কেন যে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তাও বুঝতে পারছি না।