রাজধানী ঢাকার আবাসিক ও শিল্প-কারখানায় ব্যবহূত প্রায় ৭০ শতাংশ পানি উত্তোলন হচ্ছে ভূগর্ভস্থ থেকে। এতে করে ঢাকায় প্রতি বছর দুই থেকে তিন মিটার পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। তবে উত্তোলন করা পানির ২৫ শতাংশই অপচয় হচ্ছে প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন ত্রুটির মাধ্যমে। এতে করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে ঢাকা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় ১৯৯৬ সালে পানির স্তর ছিল ২৫ মিটারে। যা ২০০৫ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ৪৫ মিটারে। ২০১০ সালে পানির পরিমাণ আরও কমে ৬০ মিটারে দাঁড়ায়। বর্তমানে অর্থাৎ ২০২৩ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের পরিমাণ নেমেছে ৭৫ মিটার বা ১৬৪ ফুটে। তবে ২০৫০ সালের মধ্যে এই স্তরের পরিমাণ নেমে যেতে পারে ১২০ মিটারে। মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনে ঢাকাসহ তার পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চল ও বরেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিস্তর আশঙ্কাজনক হারে স্থায়ীভাবে নেমে যাচ্ছে।
ওয়াসার এক তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকায় ২০২৫ সালে প্রতিদিন পানির চাহিদা থাকবে ৩৫ লাখ ঘনমিটার। এই চাহিদা বেড়ে ২০৩০ সালে দাঁড়াবে ৪৩ লাখ ঘনমিটারে। তাছাড়া ২০৩৫ সালে প্রতিদিন ৫২ লাখ ঘনমিটার পানির চাহিদা থাকবে ঢাকাতে। পরিসংখ্যান বিষয়ক জার্মান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টারের তথ্য অনুসারে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি বর্গকিলোমিটারে মানুষ বাস করে ২৮ হাজার ৯৫৮ জন। অথচ ঢাকায় প্রতি কিলোমিটারে বাস করছে সংখ্যা ৩০ হাজার ৯১১ জন। তাই এর থেকেই বুঝা যাচ্ছে ঢাকার জনঘনত্ব কতটা বেশি। পানির চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।
পাউবোর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭০ সালেও ঢাকা শহরে ৬ মিটার বা প্রায় ২০ ফুট মাটির নিচেই পানি পাওয়া যেত। অথচ ২০২৩ সালে ৭৩ মিটার বা প্রায় ২৪০ ফুটের আগে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ভূ-উপরিস্থ দূষিত পানি ব্যবহারে পানিবাহিত রোগ হতে জনগণকে রক্ষাকল্পে বিগত দশকগুলোতে ভূগর্ভস্থ ১০ থেকে ১০০ মিটার গভীরতায় হাতে চালিত নলকূপ স্থাপন করা হয়। সেচকাজে প্রথমদিকে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও সময়ের সাথে অগভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অ-গভীর সেচ নলকূপের সংখ্যা দ্রুতহারে বেড়ে বর্তমানে ১৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যা ২৭ বছরে কমেছে ৮০ দশকের প্রথমার্ধে ছিল এক লাখেরও কম। ভূগর্ভস্থ পানির অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনের ফলে শিলাস্তরের পানি সরবরাহ ক্ষমতা ও এর গুণাগুণ নষ্টে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। জাতিসংঘের এক সামপ্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৫ থেকে ২৪ শতাংশ ভূমি এলাকা উচ্চ পর্যায়ের আর্সেনিক, লবণাক্ততা ও ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছে। ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ভূগর্ভের বালির স্তরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তা এখন পর্যন্ত ভূমিধস ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলাধারের উপরের অংশের পুরু পলির স্তর বালির কণা পুনর্গঠন ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার চাপ সামলে নিতে পারছে। যখন ওয়াসা এবং অন্যান্যরা গভীর নলকূপের সাহায্যে ৩০০ মিটার বা ৯৮৪ ফুট গভীর থেকে পানি উত্তোলন করতে শুরু করবে তা হবে অপূরণীয় ক্ষতির কারণ। পলির ধরনের ওপর নির্ভর করে বৃষ্টি বা বন্যার পানি ১০০ মিটার বা ৩২৮ ফুট গভীরে যেতে অন্তত ১০০ বছর এবং ৩০০ মিটার বা ৯৮৪ ফুট গভীরে যেতে প্রায় এক হাজার বছর সময় লাগে। পাউবোর গবেষণায় আরও দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬১টি জেলার ব-দ্বীপ ও পাললিক সমভূমি অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পাঁচ থেকে ৫০ মিটার অগভীর পানিতে আর্সেনিক দূষণ প্রতি লিটারে যথাক্রমে শূন্য দশমিক শূন্য এক এবং শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ মিলিগ্রামের অধিক চিহ্নিত হওয়ায় সহজলভ্য বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি প্রাপ্যতায় গভীর সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ইউএনডিপি কর্তৃক নির্মিত পানিবাহী প্রধান শিলাস্তরের প্রায় ১০০ থেকে ২০০ মিটার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত খনিজ লোহা ও ম্যাঙ্গানিজ এবং উপকূলবর্তী অঞ্চলের অগভীর শিলাস্তরসহ কোথাও কোথাও ২০০ থেকে ৩০০ মিটার পানিতেও লবণাক্ততার উপস্থিতি পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞ ড. কাজী মতিন আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমতে থাকলে কয়েক দশকের মধ্যেই মিঠা পানির শূন্যতায় পড়তে পারে। ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ অসীম না। সরকারকে অবশ্যই জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় এর ব্যবস্থাপনা করতে হবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন নদী ও পুকুরের পানি পরিশোধন করে ব্যবহার করতে পারলে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা কমে যাবে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলেও এমনটা হচ্ছে। দেশের কোথাও কোথাও ২০০ ফুটের বেশি পানির স্তর নেমে গেছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয় বৃষ্টির পানি দ্বারা পূরণ হয়ে থাকে। কিন্তু পরিমাণের চেয়ে পানি বেশি উত্তোলিত হলে তা পূরণ হয় না। পানির স্তর কমে যাওয়ার ফলে সেখানে দূষিত পানি আসতে পারে। পানির অপচয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। কাদামাটির স্তরগুলো বালির স্তরগুলোর ঠিক বিপরীত আচরণ করে। কাদার স্তরে (যার পুরুত্ব ৬০ ফুট পর্যন্ত) কোন অব ডিপ্রেশন তৈরি হলে ভূমিধস হতে পারে এবং ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রধান গবেষক ও পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ আমার সংবাদকে বলেন, রাজধানী ঢাকায় পানির স্তর বছরে ৭ ফুট বা দুই মিটারের বেশি নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে, ঢাকার ভাগ্য একদিন কেপটাউন বা জোহানেসবার্গের মতো হতে পারে। রাজধানীর বাইরের পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। নলকূপ, যেগুলো প্রায় এক দশক আগেও খাবার পানির উৎস হিসেবে ব্যবহূত হতো, সেগুলো এখন আর ১৬৫ ফুট নিচে মিঠা পানি তুলে আনতে পারছে না। অগভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিক থাকে এর সঙ্গে আরও আছে ম্যাঙ্গানিজ ও আয়োডিন যা পানিকে অনিরাপদ করে তোলে। তাই এক হাজার ফুট নিচ থেকে বিশুদ্ধ পানি আনার জন্য এখন গভীর নলকূপেই ভরসা। সার্বিকভাবে ঢাকা নিশ্চিতভাবেই ভয়াবহ সংকটে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও পানির এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেও মিঠা পানির রিজার্ভে হুমকি বাড়ছে। তারপরও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হলে ঢাকা সংকটমুক্ত থাকতে পারে।
ড. আনোয়ার জাহিদ আরও বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত ৫০ বছরে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩০ থেকে ৭০ মিটার নিচে নেমে গেছে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কয়েক দশক থেকে ব্যাপক হারে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে অনেক অঞ্চলে হাতে চালিত নলকূপের পানি উত্তোলনের স্তর সাত দশমিক পাঁচ থেকে আট মিটার নিচে নামিয়ে দিয়েছে। ফলে পানীয় ও গৃহস্থালি কাজে পানি প্রাপ্যতায় সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার পরিবর্তন অর্থাৎ প্রকৃতিগত উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানিতলের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর প্রবাহ হ্রাসজনিত কারণেও ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদের পরিমাণ ও গুনগত মান বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।