চলমান জ্বালানি সংকটে বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিল্প খাতে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে কোম্পানিগুলো। কারখানগুলোতে উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে। বন্ধ হয়েছে বহু কারখানা। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহারের কথা ভাবছেন মালিকরা। ইতোমধ্যে এর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে নীতিমালা প্রণয়নে একটি প্যানেল গঠন করেছে সরকার। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহারের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে। সভায় এলপিজি ব্যবহারের জন্য খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক শামীম খানকে প্রধান করে গঠিত ১৪ সদস্যের কমিটি আগামী দুই মাসের মধ্যে নীতিমালার খসড়া তৈরি করতে বলা হয়েছে। এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলওএবি) সভাপতি ‘এলপিজি : বাংলাদেশের শিল্পের জন্য বিকল্প জ্বালানি সমাধান’ শীর্ষক প্রতিবেদন পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বিষয় উপস্থাপন করেন। দুই বছর আগে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতে বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। হুহু করে বেড়ে যায় সব ধরনের আমদানি পণ্য। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে জ্বালানি খাতে। দেশে ডলার সংকট দেখা দেয়। ফলে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে দেশে। বিদ্যুতে লোডশেডিং করতে হয়েছে প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টা। এরপর দেশীয় উৎপাদনে মনোযোগ দেয় সরকার। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্যাসকূপের সন্ধানও মেলে। এতে এই খাতের সংকট অনেক খানি কেটে ওঠবে ধরণা সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে কিছু সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে অন্যান্য জ্বালানির সঙ্গে এলপিজি ব্যবহারের প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিক দিকগুলো নিয়ে তুলনামূলক আলাপ আলোচনা করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি। কমিটির প্রধান জানান, খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের আগে আমরা ব্যবহারকারী, সরবরাহকারীসহ সব অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা করব। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বর্তমানে মিলগুলো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি) পরিচালিত হয়, যার প্রাথমিক উপাদান মিথেন। অন্যদিকে এলপিজির প্রাথমিক উপাদান হলো প্রোপেন, তাই মিল চালানোর জন্য এটি ব্যবহার করা যায় না। মিথেন থেকে প্রোপেন ব্যবহারের বিষয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তারা সেসব উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক আসিফ ইব্রাহিম বলেন, বাংলাদেশে অনেক কারখানা ডিজেল জেনারেটরের মতো প্রচলিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে এলপিজি ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, তবে ডিজেলের তুলনায় এলপিজি পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর ব্যবহার বায়ুদূষণ ও গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে সহায়তা করতে পারে। তিনি আরও বলেন, এলপিজি রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর পরিচালন ব্যয় কমাতে সহায়তা করতে পারে। তবে এই পরিবর্তনের জন্য কারখানা মালিকদের বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। তিনি মন্তব্য করেন, সরকারের উচিত হবে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে এলপিজিতে স্থানান্তরিত কারখানাগুলোকে নগদ প্রণোদনা, ট্যাক্স বিরতি ও পর্যাপ্ত সময় দেয়া।
‘এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এলপিজি প্রথাগত জ্বালানির তুলনায় অনেক সুবিধা দেয়। কিন্তু এর ব্যবহার নিয়ে এখনো বিবেচনা করতে হবে, যেমন— নিরাপদ হ্যান্ডলিং ও মজুত করা নিয়ে,’ বলেন তিনি। তিনি জানান, এলপিজি বিতরণ ও মজুতের জন্য সরবরাহ এবং অবকাঠামো পর্যাপ্তভাবে বিকশিত করা দরকার, যেন শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়। বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক জাকারিয়া জালাল বলেন, শিল্প কারখানাগুলোতে এলপিজির ব্যবহার বাড়ানো চ্যালেঞ্জিং, কারণ এলএনজির সঙ্গে দামের পার্থক্য আছে। বাংলাদেশের এলপি গ্যাসের বাজারে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেড শীর্ষ প্রতিষ্ঠান, ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের এলপিজি বাজারের ২৪ শতাংশ তাদের। জাকারিয়া জালাল বলেন, বর্তমানে এলপিজির দাম কেজিপ্রতি ১০৩ টাকা এবং এলএনজির দাম ৪০ টাকা কেজি। তিনি বলেন, ‘এলএনজি থেকে এলপিজি ব্যবহারে শিল্পপতিরা আগ্রহী হবেন না।’ দেশের প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের গৃহস্থালি জ্বালানির বিপুল চাহিদা মেটাতে নিরবচ্ছিন্ন এলপিজি সরবরাহ সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানি পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন দিন দিন কমায় এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় বিকল্প জ্বালানি উৎস ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ নেই, তাই এসব এলাকায় শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। বিকেএমইএর সভাপতি বলেন, নারায়ণগঞ্জের অনেক শিল্পকারখানা বেশ কিছু দিন যাবৎ গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছে না।