- হামলার শিকার ঝিনাইদহ-২ আসনে মুক্তিযোদ্ধার সংবাদ সম্মেলন
- ট্রাকে ভোট চাইলে পিছমোড়া বাঁধার হুমকি নাটোর-৪ নৌকার প্রার্থীর
- উল্টাপাল্টা করলে সোজা করার হুমকি কুষ্টিয়া-১ নৌকার প্রার্থীর
- প্রতিপক্ষকে ঘাড় মটকে দেয়ার হুমকি সমাজকল্যাণমন্ত্রীর
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি না থাকলেও নির্বাচনি কার্যক্রম থেমে নেই। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা দেয়ার পরপরই ভোট অংশ নিতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকাকে চ্যালেঞ্জ করে মাঠে শক্তি দেখানোর মতো কোনো রাজনৈতিক দল অংশ না নেয়ায় ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন দলটির মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা। যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। এ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে নৌকার জন্য টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এর কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটে ২৯টি দল অংশ নিলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো শক্তি সামর্থ্য ও জনপ্রিয়তা অন্য কারো নেই। ফলে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর হামলা ও হুমকি-ধমকির শিকার হচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতাকর্মীরা।
প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো নির্বাচনি আসনে হামলার শিকার হচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীরা। প্রতিনিয়ত হুমকির শিকারও হচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কর্মী ও সমর্থকরা। হুমকি ও হামলার শিকার হয়ে কেউ সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিচার চেয়েছেন। আবার কেউ নির্বাচনি কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় আওয়ামী লীগের পদধারী অনেক নেতাই নৌকার প্রার্থীর লোকজনের হামলার শিকার হয়েছেন, হামলা থেকে রেহাই পাননি মুক্তিযোদ্ধাও। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে, দু’-এক স্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের হামলার শিকার হয়েছেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয় শহরের মুসা মিয়া আইসিটি সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলন করেন হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার ও চাঁদপুর ইউনিয়নের বেড়বিন্নি গ্রামের মৃত আনসার মুন্সির ছেলে তাহাজ উদ্দীন।
সংবাদ সম্মেলনে তাহাজ উদ্দীন অভিযোগ করেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় তাকে পিটিয়ে আহত করা হয়। লিখিত বক্তব্যে ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ২৯ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় জিন্দারের মোড় বাজারে চুল কাটানোর উদ্দেশে যান তিনি। এ সময় নৌকা প্রতীকের সমর্থক ও চাঁদপুর ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশিদুল্লাহ রাশিদ দৌড়ে এসে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। একপর্যায়ে গালাগালের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, তুই নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে কাজ করতেছিস— বলে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন। মারপিটের ফলে রাস্তার ওপর পড়ে যান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার চিৎকার শুনে পাশের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করেন। তার অভিযোগ, রাশিদুল্লাহ তাকে খুন জখমের হুমকি দেয়, তিনি প্রাণ নিয়ে শঙ্কিত। এ ঘটনায় হরিণাকুণ্ডু থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন তিনি। এমন ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে দেশজুড়ে।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে নৌকায় ভোট না দিলে হাত কেটে নেয়াসহ ‘গুলি’ করার হুমকি দিয়েছেন সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলী ইস্কান্দার। গত ২৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে উপজেলার তালেবপুর ইউনিয়নের ইরতা গ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুর কর্মীরা প্রচারণা চালানোর সময় এই হুমকি দেন তিনি। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর) আসনে আ.লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ড. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারীকে কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) দিয়েছেন নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি।
নাটোর-৪ আসনের নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান ও পাবনার সহকারী জজ আরিফুল ইসলামের শোকজ নোটিসে জানা গেছে, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষের লোককে হুমকি দিয়েছেন। ওই নোটিসে বলা হয়, মো. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী আপনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নাটোর-৪ আসনে আ.লীগ মনোনীত প্রার্থী। গত ২৫ ডিসেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিউজ ওই কমিটির নজরে এসেছে। যেখানে নির্বাচনি প্রচারণার একটি সভার বক্তব্যে আপনি বলেন, ‘কোনো মেম্বর-চেয়ারম্যান এসে ট্রাক মার্কার ভোট চাইলে তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখবেন। কারণ মেম্বর-চেয়ারম্যান নৌকা নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের নৌকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ ওই বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।
চট্টগ্রাম-১০ (চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ২৫ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোস্টার পোড়ানোর অভিযোগ ওঠে আ.লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী মো. মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে। এ কারণে গত ২৬ ডিসেম্বর নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান তাকে শোকজও করেন।
কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে আ.লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহান বাদশাহর বিরুদ্ধে নৌকা প্রতীকে ভোট না দিলে ভোটারদের দেখে নেয়ার হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ২৫ ডিসেম্বর রাতে দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়নে নির্বাচনি পথসভায় তিনি এ হুমকি দেন। তার ওই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বাদশাহ বলেন, ‘আমি কে, আপনারা জানেন ও চেনেন। আমি বেশি কথা বলব না। এখানে যারা আছেন, ভোট আমাকে দিতে হবে, পরিষ্কার কথা। নৌকা মার্কায় আমাকে ভোট দিতে হবে। এই অধিকার আমার আছে। সুতরাং যার মনে যাই থাকুক না কেন, যতই নাচানাচি-গুঁতাগুঁতি করেন না কেন, মনস্থির করেন, নৌকা মার্কায় বাদশাহকে ভোট দিতে হবে। উল্টাপাল্টা দু’-একজন বকছে, সোজা করে দেবো কিন্তু। এরপরে উল্টাপাল্টা কথা যদি শুনি, সোজা করে দেবো। মনে রাইখেন।’
ঢাকা-১৯ আসন (সাভার-আশুলিয়া) থেকে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের এক কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে নৌকা প্রতীকের কর্মীদের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী মো. সিরাজুল ইসলাম। গত ২৫ ডিসেম্বর রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আশুলিয়া থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ।
বগুড়ার নন্দীগ্রামে আ.লীগের তিন নেতাকর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে নৌকার প্রার্থী ও জাসদের জেলা সভাপতি এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের ভাগনের বিরুদ্ধে। গতকাল ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে নন্দীগ্রাম উপজেলার শিমলা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। মারধরের শিকার ব্যক্তিরা হলেন— নন্দীগ্রাম সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৮ নং ওয়ার্ডের সভাপতি রুবেল হোসেন, সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক রুহুল আমিন। তারা নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন। এরা স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মোল্লার ঈগল প্রতীকের পক্ষে রয়েছেন।
গত ২৩ ডিসেম্বর সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে নৌকার প্রার্থী সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদকে বলতে শোনা যায়, সেদিন ভুলারহাটে মিটিংয়ে গোলাম মর্তুজা হানিফ যে বাজে কথা বলেছে, তাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। এ ধরনের বাজে কথা যদি আর কোনো দিন বলো, তোমার ঘাড় মটকে দেবো। তুমি এখনো লোক চেনো না। এ বিষয়ে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে হুমকির লিখিত অভিযোগ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মর্তুজা হানিফ। অভিযোগে তিনি পরিবারের সদস্যদেরসহ নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। নাটোরের গুরুদাসপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থককে পিটিয়েছেন নৌকার সমর্থক গুরুদাসপুর পৌরসভার মেয়র শাহনেওয়াজ মোল্লা। গত ২৫ ডিসেম্বর বিকেলে উপজেলার চাচকৈড় বাজারে ব্যানার টানানোর সময় তাকে পেটানো হয়। এ ঘটনায় আহত মো. নহর রহমান দিপুকে (২১) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তবে মেয়র শাহনেওয়াজ মোল্লার দাবি, তিনি নহরকে পেটাননি, ধাক্কা দিয়েছেন।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-২০ ধামরাইয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনি প্রচার ক্যাম্পে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় ওই প্রার্থী নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। গত ২৮ ডিসেম্বর সকালে উপজেলার বাইশাকান্দা ইউনিয়নের কান্দাপুটল এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাদ্দেছ হোসেনের নির্বাচনি ক্যাম্পে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে।
এদিকে ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে পিরোজপুরে। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পিরোজপুর সদর উপজেলা আ.লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে পিরোজপুর জেলা আ.লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম হিরুর ওপর হামলা চালিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম এ আউয়ালের সমর্থকরা। পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে ২৯ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার সময় তৌহিদুল ইসলাম হিরুর ওপর ওই সন্ত্রাসী হামলা হয়। গুরুতর আহত তৌহিদুল ইসলাম হিরুকে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করার পর রাত সাড়ে ৩টায় অবস্থার অবনতি হওয়ার পর খুলনা সিটি হাসপাতালে ভর্তি হয়।
গত ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডিতে আ.লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর আ.লীগের কর্মী-সমর্থকদের হামলা বিচ্ছিন ঘটনা।’ তিনি বলেন, নির্বাচনে এসব বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত (হামলার) ঘটনা ঘটে। আমি মনে করি, এতে স্বতন্ত্র প্রার্থী, নৌকার প্রার্থী বা অন্য দলের প্রার্থীদেরও নির্বাচন বয়কট করার কোনো কারণ নেই।