- বিএনপিবিহীন প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে না —দাবি দলটির
- ভোটপূর্বে ক্ষমতাসীন দলের ধ্বংসাত্মক নাশকতা আভাসে সতর্কতা
- দলীয় অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে টিকে থাকা ঝুঁকি রয়েছে
- নৌকা প্রার্থী, ডামি প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী সংঘাতে জড়ালে বিএনপির লাভ
- ভোট গ্রহণযোগ্য না হলে বিশ্ব থেকে দেশ বিচ্ছিন্ন হতে পারে —ভাষ্য ইসির
- বিএনপিসহ ৬০ দল ছাড়া ভোট গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলে দাবি
নির্বাচনে সংঘাতের সংখ্যা বড় আকারের হতে পারে, ভয়ের শঙ্কায় বিএনপি জানে ভোটে টিকে থাকতে পারবে না
—শারমিন মুরশিদ, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
কেউ আর ভোটকেন্দ্রে যাবে না, জনতার আন্দোলনে এই সরকার থাকবে
না তাদের পতন ঘটবেই
—রুহুল কবির রিজভী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বিএনপি
ভোটের বাকি আর মাত্র তিন দিন! চতুর্থ দিন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এখনো বড় কোনো কর্মসূচিতে নেই বিএনপি। ভোটকেন্দ্রে না যেতে ভোটারদের লিফলেট দিয়ে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। দলটির হাইকমান্ড মনে করছে, এবার দেশে কোনো প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে না। বহির্বিশ্ব এ নির্বাচনকে কোনো বৈধতা দিচ্ছে না। সরকার বহুমুখী চাপের মধ্যে রয়েছে। যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। ভোটকে সামনে রেখে নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল ধ্বংসাত্মক নাশকতা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা চালাতে পারে। এ জন্য বিএনপি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিভাগীয় সাংগঠনিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এমন বার্তা দিয়েছেন। তৃণমূল থেকে বলা হচ্ছে, মাঠপর্যায়ে কোনো ভোটের উৎসব নেই। বিরোধী দলের কোনো নেতাকর্মী ঘরে ঘুমাতে পারছেন না। বন-জঙ্গলে রাত যাপন করছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন অনেক উত্তাপ ও আবেগ কাজ করছে, কর্মসূচি পালনে কৌশলকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ভোট পূর্ব প্রথম সপ্তাহ বড় কর্মসূচির সিদ্ধান্ত থাকলেও তা থেকে সরে আসে দলাট। দলটি সাংগঠনিক নেতাদের বার্তা দিয়েছে, তৃণমূল নেতাদের শৃঙ্খলিতভাবে এখন ধরে রাখতে হবে। হামলা-আক্রমণে কোনো নেতাকর্মীর জীবন যাক এটি কেউ চাচ্ছেন না। কয়েক লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যারা আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করছেন। দলীয় নেতাকর্মীরাই গত ১৫ বছরে বেশি নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে নিরস্ত্র লড়াই করে টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হবে। এখন ভোটারদের বিমুখ রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ এবং কূটনৈতিক যে প্রেশক্রিপশন রয়েছে সেই আলোকে চলাকে বড় আন্দোলন মনে করছেন তারা।
বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রার্থী, ডামি প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী এখন নির্বাচনি দৌড়ে রয়েছেন। ভোটের মাঠে কোনো উৎসব নেই। ভোট নিয়ে মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। এমন পরিস্থিতে তাদের অনুগত শরিকরা জয় নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। যারা আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা দিয়ে ভোটে গেছেন তাদের অনেকেই জিতে আসতে পারবেন না। জাতীয় পার্টির মধ্যে শঙ্কা থেকে এখনই ভাঙন তৈরি হচ্ছে। একাধিক প্রার্থী ভোট থেকে সরে গেছেন। দলটির শীর্ষ নেতা জিএম কাদের বলেছেন, তারা শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকবেন কি-না তা এখনো নিশ্চিত নয়। সেই সাথে বিশাল সংখ্যক আওয়ামী লীগ প্রার্থী ক্ষুব্ধ। কারণ, তাদের নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের মধ্যেই বড় ধরনের সংঘাতের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
ইতোমধ্যে নিজেরা নিজেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে জড়িয়েছেন। প্রাণ গেছে বেশ কয়েক জনের। দেশের কূটনৈতিক মহলগুলো তাদের দূতাবাসকে বিশেষ বার্তা দিয়ে সতর্ক করেছে। ভোটের মাঠে বিরোধীদল না থাকা, নেতাদের ধরে ধরে সাজা, সংঘাত, উৎসবের প্রভাব না পড়ায় বিদেশিরা এ নির্বাচনকে কোনোভাবেই বৈধতা দেবে না বলেই মাঠ নেতাদের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা, মহানগর এমনকি থানা-উপজেলা পর্যায়েও নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলছেন তারেক রহমান। যদি এমন কোনো দৃশ্যপট তৈরি হয় শর্ট টাইমের মধ্যে আন্দোলন প্রয়োজন হতে পারে তারা সেটিও করবে। তখন ঢাকা থেকে সারা দেশ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এমন কর্মসূচি বাস্তবায়নে যদি জামায়াতকে এক ব্যানারে নিয়ে আশা প্রয়োজন হয় সেটিও করা হবে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে খবর প্রচার হয়েছে এবারের ভোটকে সরকারের ‘স্পেশাল ইলেকশন অপারেশন (বিশেষ নির্বাচনি কার্যক্রম)’ হিসেবে দেখছেন পশ্চিমা কূটনীতিকরা। সরকার কী করছে, মাঠে কী হচ্ছে, হাজার হাজার বিরোধী দলের নেতাকর্মী অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় কারাগারে রয়েছেন, তাদের সাজা দেয়া হচ্ছে। বিএনপিসহ অন্তত ৬০ দল ভোটের মাঠে না থাকা, ভোটে জনগণের আগ্রহ ও উৎসব না থাকা— এগুলো তারা উল্লেখ করেছেন। দূতাবাসগুলোর পাঠানো প্রতিবেদন প্রসঙ্গে গত ১৭ ডিসেম্বর একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারে বলেন, বিএনপি নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা রাজি হয়নি। দেশে অস্থিতিশীলতা এড়াতে বিএনপি নেতাকর্মীকে আটক রাখা ছাড়া সরকারের কাছে কোনো বিকল্প ছিল না। এ বিষয়গুলো থেকে সরকারের উদ্দেশে দেশের জনগণের সঙ্গে এখন সারা দুনিয়া অবগত। বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক বিএনপির মাঠপর্যায়ের কেমন জনপ্রিয়তা রয়েছে, কত শতাংশ ভোট রয়েছে বিশেষ সংস্থাগুলোর জরিপ নিজ নিজ কূটনৈতিক দূতাবাসে রয়েছে। এ জন্য দলটির মধ্যে এখন আত্মবিশ্বাস কাজ করছে— আওয়ামী নির্বাচন করে সফল হতে পারবে না। তারা জ্বালাও-পোড়াও করে সরকারের ফাঁদে পা দেবে না। প্রয়োজন হলে পরিস্থিতি নিয়ে তারা জনগণকে সাথে নিয়ে রাজপথে নেমে আসবে।
বিএনপি মনে করছে, এ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনও এখন সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। নানা চাপের মধ্যে তাদের মুখ থেকে সত্য কথা বেরিয়ে পড়ছে। গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য না হলে বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করলে হবে না— তাদের দিকে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে। তারা যদি নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য করতে না পারেন তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশের সব বিষয়; বিশেষ করে আর্থিক, সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কিছু থমকে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
যে কারণে বিএনপি সঠিক পথে : বিএনপির রাজনীতিতে চোখ রাখা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল এ সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। বেলাশেষে দ্বিমুখী আচরণ করে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ড. কামাল হোসেনের হাত ধরে ভোটে গিয়ে তাদের ভরাডুবি হয়েছে। পাঁচ-ছয়জন সাংসদ নিয়ে যায় সংসদেও! এবার বিএনপি পাঁচ বছর আগে থেকে যে ঘোষণা দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আ.লীগের অধীনে ভোটে যাবে না সেটি তারা রেখেছে। অতীতে আওয়ামী লীগের ফাঁদে বিএনপি পা দিলেও এবার বিএনপির ফাঁদে আওয়ামী লীগ পা দিয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন। এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে মানোন্নয়ন ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে দলটির। বিএনপি এবার পরিকল্পনা নিয়েই রাজনীতিতে টিকে গিয়েছেন। দলটিতে সরকার চেষ্টা করেও কোনো ভাঙন ধরাতে পারেনি। নিষ্ক্রিয় দু’-একজন নেতা আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা দিয়েছেন এ নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। এখন তারেক রহমানের উপর আস্থা রেখে কেউ বিচ্যুতি হয়নি। এটিই একটি দলের বড় সফলতা।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমার সংবাদকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, বাক-স্বাধীনতা হরণ করেছে। তারা আবারও মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার আরেকটি সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করতে চাচ্ছে। কিন্তু এবার আর প্রতারণার নির্বাচন করে পার পাওয়া যাবে না। দেশের মানুষ সচেতন হয়ে গেছে । কেউ আর ভোটকেন্দ্রে যাবে না। জনগণ এখন বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন করছে। এই সরকার থাকবে না, তাদের পতন ঘটবেই। জনতার আন্দোলনে এই সরকার ভেসে যাবে।’
ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দল একটি নির্বাচন করছে, কী করে ধরে নিলেন উপর থেকে একটি নির্দেশনা দিলে সেটি মাঠপর্যায়ের স্বতন্ত্র নেতারা মানবেন। যারা জেতার আশাতে নেই তারা কেউ মাঠে নেই। আর যেখানে টাকা খরচ হচ্ছে, শক্তি খরচ হচ্ছে, সেখানে মারামারি হচ্ছে। নির্বাচনের আগে-পরে বড় সংখ্যা দাঁড় হতে পারে সংঘাতের। তবে আমরা চাই না এই সংখ্যা উপস্থাপনের। আমার প্রশ্ন, কত মানুষ মারা গেলে, কত মানুষ আহত হলে, কত সংঘাত হলে আমি বলব নির্বাচন সহিংস হয়েছে? কতটুকু ঘটনা ঘটলে আমি বলব এই নির্বাচন হওয়া উচিত নয়।’ বিএনপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপি ভালো করে জানে, তারা মাঠে টিকে থাকতে পারবে না। সে জন্য তারা ভোটে আসেনি। একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেটি ভয়ের আতঙ্কের, এটি একটি রাজনৈতিক দলের অবশ্যই পর্যবেক্ষণ রয়েছে।’