- ৭ জানুয়ারি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না, সরকারও ক্ষমতার বৈধতা পাবে না —ভাষ্য বিএনপির
- রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার পদ্ধতির দিকে বিএনপির মনোযোগ
- বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ ৬৪টি দল ভোটের বাইরে
- সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না বিদায় করুণ হবে
—কর্নেল (অব.) অলি
- বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন কারো কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না
—বদিউল আলম মজুমদার
এক দিন পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের রাজনৈতিক দলের একাংশে নেই ভোটের আগ্রহ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনাস্থা জ্ঞাপন করে ভোটে যায়নি বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ ৬৪টি রাজনৈতিক দল। ভোটে না গিয়ে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে তৃণমূল নেতারা দুঃসময় পার করছেন। বিএনপির সেকেন্ড ইন কমান্ড মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থানীয় কমিটির নেতাসহ প্রথম সারির অন্তত ১০০ নেতা কারাগারে। সারা দেশে প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মী ভোট উৎসবের সময় কারাবন্দি রয়েছেন। গত দু-তিন মাসে প্রায় ১৩০০ নেতাকর্মীর সাজা হয়েছে, যাদের অধিকাংশেরই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না। নির্বাচনি প্রচারকালীন সময়ে সরকারবিরোধী নেতাকর্মীরা কেউ ঘরে থাকতে পারেননি বলে অভিযোগ।
গ্রেপ্তার এড়াতে বন-জঙ্গলে তারা সময় পার করছেন— এমন ছবি প্রকাশ করে জানিয়েছে বিএনপি মিডিয়া সেল। এমন কঠিন সময় পার করলেও হাইকমান্ড থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো হতাশা নেই। তারা মনে করছেন, এবার বিএনপি সঠিক সিদ্ধান্তেই রয়েছে। অতীতে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে এবার আগেই দলটি স্পষ্ট করতে পেরেছে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি যা-ই বলেন, তা-ই হয় ভোটের ফলাফল। তাই এবার বিএনপিসহ দেশের সিংহভাগ দলই ভোটে যায়নি। বিএনপির নির্ভরযোগ্য নেতারা বলছেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি খুব শিগগিরই পরিবর্তন হবে। আগামী ৭ জানুয়ারি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না; সরকারও ক্ষমতার বৈধতা পাবে না। এর সঙ্গে শুধু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়, সঙ্গে ক্ষমতার বৈধতা, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সবকিছুই জড়িত। নির্বাচন হলেও দেশের জনগণ এই সরকারকে বৈধতা দেবে না। মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে না।
এ বিষয়ে বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান এবং অন্তত তিন নির্বাহী কমিটির সদস্যের সঙ্গে কথা হয় আমার সংবাদের। তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে আমার সংবাদকে বলেন, দেশে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন সরকারই প্রার্থী, তারাই ডামি, আবার তারাই স্বতন্ত্র। নির্বাচনের আগে বড় কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে ধাক্কা দেয়ার বড় ছক কষা ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার নৈরাজ্য-নাশকতা চালিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপাতে পারে— এমন পরিকল্পনা জানতে পেরে তারা অন্য পথে হাঁটছেন। তারা বলছেন, এবার বিএনপি আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা দেবে না বরং আওয়ামী লীগই বিএনপির ফাঁদে পা দেবে। ক্ষমতাসীন সরকার যদি সব রাজনৈতিক দল নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন করত, তাহলে সরকারের বিদায় কিছুটা হলেও সহজ হতো। এখন আর সরকারের বিদায় সহজ হবে না। বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হলেও বৈধতা পাবে না। এই সরকার দেশি-বিদেশি সব পরামর্শকে তোয়াক্কা না করে যে পথে হেঁটেছে, তার করুণ পরিণতি ভোগ করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দলটির নির্ভরযোগ্য নেতারা বলছেন, নির্বাচন হলেও ক্ষমতাসীন সরকারকে খুব খারাপ পরিণতির মাধ্যমে বিদায় নিতে হবে। এরপর দেশে কিছু সময় সংস্কার হবে। তারপর আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব, বিচার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার ব্যতীত কোনো রাজনৈতিক দল সরাসরি ক্ষমতায় আসবে না। বিএনপিও এই সংস্কার পদ্ধতির সঙ্গে একমত রয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করেছে বিএনপি, জামায়াত ও সমমনা দলগুলো। গতকাল দলটির পক্ষ থেকে ভোটের দিন ও তার আগের দিন, অর্থাৎ কাল শনি ও পরদিন রোববার ফের হরতালের ডাক দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১২ দফায় ২৩ দিন সারা দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে তারা। গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে তিন দফায় টানা আট দিন গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে। আজ শুক্রবার সারা দেশে মিছিল করবে দলটি। বিএনপি নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন, তাদের কর্মসূচিতে জনগণ সাড়া দিয়েছে। কেউ ৭ তারিখে ভোট দিতে যাবেন না। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল পাড়া-মহল্লায় গ্রামে-গঞ্জে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় ভোটারদের আইডি কার্ডও নিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভোট দিয়ে ভোটার আইডি কার্ড ফেরত নিয়ে যেতে। সাধারণ নাগরিকরা ভোটকেন্দ্রে না গেলে বিদ্যুৎ-গ্যাসের লাইন কেটে দেয়া হবে বলেও হুমকি দেয়া হচ্ছে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমার সংবাদকে বলেন, দেশে কোনো ভোট হচ্ছে না। কোনো সচেতন নাগরিক ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। এটা হচ্ছে আমি-তুমি ডামি নির্বাচন। এই সরকার দেশের নাগরিকদের নিয়ে অনেক রঙ-তামাশা করেছে। ৭ তারিখে আরেকটি প্রহসন ও রঙ-তামাশার ভোটের আয়োজন করেছে। জনগণ আর এই সরকারকে ছাড় দেবে না। এই সরকারের বিদায় খুবই কঠিন হবে। দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের বিদায় হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, দেশে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। এটাকে নির্বাচন বলা যায় না। ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। পরের নির্বাচন একতরফা। ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল অংশগ্রহণমূলক; কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নয়। কিন্তু এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলকও নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকও নয়। বাংলাদেশে দুটো রাজনৈতিক দল— একটি আওয়ামী লীগ, আরেকটি বিএনপি। এর একটিকে বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। এক কথায় বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম আমার সংবাদকে বলেছেন, বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে না। এখন যেটি হচ্ছে, সেটি হলো আসন ভাগাভাগি। কে কোন আসনে সংসদ সদস্য হবে, তা আগেই নির্ধারণ হয়ে গেছে। বাকি যেটি হচ্ছে, তা হলো আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাই ভাই খেলা। বিএনপি-জামায়াতকে বাদ দিয়ে গুটিকয়েক দালাল নিয়ে যদি ভোট হয়, সেটি অংশগ্রহণমূলক হবে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক তো হবেই না। তিনি আরও বলেন, বহুদিন থেকে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের নেতারা আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করছে। এবারও তারাই ভোটে রয়েছে আর সঙ্গে নতুন কিছু দালাল যুক্ত হয়েছে। এটা দিয়ে সরকার পার পাবে না। এই সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না, সরকারের বিদায় করুণ হবে। এখন আর সহজ বিদায় হবে না। বহু লোক মারা যেতে পারে। বহু ধরনের অঘটন বাংলাদেশে ঘটতে পারে।