- পণ্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা
- সার্বিক অর্থনীতিকে ঝুঁকিমুক্ত করা
- বিরোধী দলগুলোকে মোকাবিলা করা
- দরিদ্র-কর্মহীনদের মূলস্রোতে নিয়ে আসা
- কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা
- দ্বাদশ নির্বাচনি ইশতেহারের বাস্তবায়ন
দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি ঠেকিয়ে পণ্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতিকে স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলা ও কর্মহীন দরিদ্র মানুষদের সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পঞ্চমবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার। দায়িত্ব পালনকালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে রাজপথে আন্দোলনে থাকা বিরোধী দলগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। তবে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মনে করেন, সরকারের চ্যালেঞ্জ তিনটি। সেগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বিরোধী দল ছাড়া মিত্র দলগুলো নিয়ে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসা এই সরকারের পথচলা খুব সহজ হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তাছাড়া নির্বাচনি ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নও দলটির জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এবার টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকারে আসতে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশেষ করে ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’— এমন স্লোগানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করে দলটি। এবার ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্বপ্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’— এই চারটি স্তম্ভের সমন্বয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দেয় দলটি। সরকার গঠন করলে রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা আরও সুদৃঢ় করার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। যেখানে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিশ্চিত হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। নাগরিককেন্দ্রিক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, জ্ঞানভিত্তিক, কল্যাণমুখী, সমন্বিত দক্ষ স্মার্ট প্রশাসন গড়ার মাধ্যমে জনগণকে উন্নত ও মানসম্মত সেবা প্রদান এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয় আওয়ামী লীগ।
ভোটের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল মুদ্রা সরবরাহ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়-উপকরণ হবে নীতি সুদহার ব্যবহার। কর্মোপযোগী প্রশিক্ষিত যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ঋণ সরবরাহ সম্প্রসারণ করা হবে। আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে অনিশ্চয়তা লাঘব করবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং এক্ষেত্রে ব্যাংক যাতে বিধিনির্ধারিত সঞ্চিতি নিশ্চিত করা হবে। পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে ঘুস-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ, ঋণ-কর-বিলখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
দারিদ্র্যের হার ১১ শতাংশে, চরম দারিদ্র্যের অবসান এবং ২০৪১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার তিন শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয় আওয়ামী লীগ। দলটি ঘোষণা করে, দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক চাহিদা অনুযায়ী ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা হবে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের আইনসংগত সহায়তায় কার্যকর ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা হবে। বিদেশে নারী শ্রমিকদের প্রতি ন্যায্য আচরণ সংরক্ষণে আইনসংগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষায় জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আবশ্যক পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখবে দলটি— এমন ঘোষণাও দেয়া হয়।
নির্বাচনি ইশতেহারে দলটি যা-ই ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি দিক না কেন, দেশের সর্বস্তরের মানুষ সরকারের কাছে যা যাচ্ছে, তা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য ক্রয়সীমার মধ্যে নিয়ে আসা। অর্থাৎ, গড়ে ১০ হাজার টাকা মাসিক আয়ে চলার মানুষগুলো যদি জীবন-সংসার চালাতে চান, তাহলে পণ্যমূল্যে আকাশছোঁয়া ঊর্ধ্বগতির মধ্যে তার পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে, সরকারকে এখন তা ভাবনায় নিতে হবে বলে মনে করছেন নাগরিকরা। কারণ, দেশে এখন মাত্র এক কেজি চালের দাম ৬০ থেকে (মানভেদে) ৯০ টাকা পর্যন্ত। পুরোপুরি মৌসুমে এখন এক কেজি গোল আলুর মূল্য ৬০ টাকা। অথচ গত বছরের এ সময় এক কেজি আলুর মূল্য ছিল মাত্র ১৮ থেকে ২০ টাকা। সাধারণ মানুষের আবশ্যকীয় সবজি হিসেবে খ্যাত এই আলুর মূল্য ৬০ টাকা হলে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষদের মোটা চালের ভাত, আলুভর্তা ও ডাল খাওয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। খাদ্যের পর মানুষের আরেকটি মৌলিক চাহিদার নাম হচ্ছে চিকিৎসা। এই চিকিৎসাসেবাও এখন অনেক ব্যয়বহুল। বিশেষ করে ওষুধের মূল্য বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ১৫ থেকে ১৮ টাকার নাপা সিরাপ এখন ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেন ওষুদের মূল্য বাড়ানো হলো— এর কোনো ব্যাখ্যাও জানেন না নাগরিকরা। প্রায় সবকিছুর অবস্থা একই। মানুষ এ অবস্থা আর দেখতে চায় না। ভুক্তভোগীরা মনে করছেন, নতুন সরকারকে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে পূর্বের অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে। বাণিজ্যের সিন্ডিকেট ভেঙে তছনছ করে দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এটা সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন নাগরিকরা।
এছাড়া সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জের আরও একটি হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ ধরে রাখা এবং পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা। হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয় দেশে প্রবেশ বন্ধ করে সঠিক চ্যানেলে তা দেশে নিয়ে আসা এবং দেশের টাকার মান ধরে রাখা।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গতকাল তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন। তার ভাষ্য হচ্ছে, ‘সরকারের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো হলো— রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। এ তিনটি খাতে বিশ্বসংকটের যে বাস্তবতা, তার প্রতিক্রিয়া থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা অত সহজ কাজ নয়।
নতুন সরকারের মন্ত্রী ও তাদের দপ্তর বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকার নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নে সমস্যায় পড়তে পারে। যেমন, নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী করা হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে। তিনি ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন; যদিও তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন। কিন্তু চাকরি জীবনে তিনি কূটনীতিক ছিলেন। অর্থ খাতে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার। ফলে নতুন সরকারের সামনে নাজুক অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনার বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কতটা সহজ হবে, তা নিয়ে অনেকে ভাবনায় পড়েছেন। এভাবে পররাষ্ট্র, কৃষিসহ অনেক মন্ত্রণালয়ই পরিচালনা করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই— এমন মন্ত্রীদের।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের পথচলা শুরু হলো গত ১১ জানুয়ারি থেকে। এদিন বঙ্গভবনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন; এরপর মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা শপথ নেন। একইদিন নতুন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের দপ্তরও বণ্টন করা হয়। এরই মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থবার সরকার পরিচালনা শুরু করল আওয়ামী লীগ।