- নির্বাচনি সংঘর্ষে নিহত ৪ আহত দুই শতাধিক
- দেড় শতাধিক অগ্নিসংযোগ ভাঙচুর-লুটপাট
- এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ
নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে
—কমান্ডার খন্দকার আল মঈন
পরিচালক, লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং, র্যাবসহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে
—আনোয়ার হোসেন
ডিআইজি (অপারেশন্স)
পুলিশ সদর দপ্তর
বিরোধী দলগুলোর ভোট বর্জনের কারণে তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় গত ৭ জানুয়ারি। বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘাত, হামলা ও পাল্টাহামলার ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটেছে ঠিকই কিন্তু অন্যান্য নির্বাচনের চাইতে তা অনেকাংশেই কম ছিল। এবারের ভোটে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোই সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ঘটেছে। ‘আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী’ আর ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীর’ সংঘাতেই ভোটের আগে ও পরে প্রাণহানিসহ নানা ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন, আহত দুই শতাধিক। ১৫০টির বেশি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। ভোট-পরবর্তী সহিংসতার আশঙ্কায় এখনো এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। কারণ, বিজয়ী প্রার্থী ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকদের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সংঘাতের শঙ্কা এখনো কাটেনি।
গত শনিবার নোয়াখালী-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক এজেন্ট শাহেদুজ্জামান ওরফে পলাশকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তিনি পূর্ব মির্জানগর গ্রামের মো. জামাল উদ্দিনের ছেলে। শাহেদুজ্জামান পূর্ব মির্জানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কাঁচি প্রতীকের পোলিং এজেন্ট ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহা. আতাউর রহমান ভূঁইয়া। তিনি অভিযোগ করেছেন, ভোটকেন্দ্রে জালভোট ও অবৈধ প্রভাব বিস্তারের প্রতিবাদ করায় ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দিন থেকে স্থানীয় নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা শাহেদুজ্জামানকে নানা হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এরই জেরে তাকে খুন করা হতে পারে বলে তার ধারণা।
এদিকে কুষ্টিয়া-৪ আসনের খোকসায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা চরম রূপ নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের সমর্থকরা। সর্বশেষ মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় বাড়ি ভাঙচুর, গরু ও নগদ টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদারীপুর-৩ আসনে (কালকিনি-ডাসার-সদরের একাংশ) ঈগল প্রার্থীর বিজয় মিছিলে বোমা হামলায় এমারত সর্দার (৪৫) নামে এক চা দোকানি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গত বুধবার সাভার পৌর এলাকার কাতলাপুরে নৌকা ও ঈগলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় নির্বাচনি প্রচারণায় সংঘর্ষে জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) নামের স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক সমর্থক নিহত হয়েছেন। নিহত জাহাঙ্গীরের ভাই আলমগীর হোসেন বলেন, ‘পিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফ আলীর সমর্থনে নির্বাচনি প্রচারণায় যান আমার ভাই। এ সময় ঈগল প্রতীকের বশির ফরাজীর লোকজন দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। এতে আমার ভাই গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
নির্বাচনি সহিংসতায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ২৫ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন যাত্রাবাড়ীর সায়দাবাদে ককটেল বিস্ফোরণে আহত আনসার ভিডিপি সদস্য অন্তর, নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার থেকে গুলিতে আহত আব্দুর নূর, সাকিব, কামাল ও সায়মন। এদিকে নির্বাচনের পরদিনই পাবনা-৩ আসনের চাটমোহর উপজেলার ফইলজানা গ্রামে নির্বাচনে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় নৌকার সমর্থক মো. আশরাফকে ছুরি মেরে আহত করা হয়।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আশরাফ নৌকার সমর্থক ছিল। এ কারণে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে ছুরি মেরেছে বলে অভিযোগ পেয়ে তদন্ত চলছে। জানা গেছে, সদ্য অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে সাড়ে তিনশর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের মাঠে উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোট না পেয়ে পরাজয়ের পর প্রতিপক্ষ এ হামলা চালায়। নির্বাচন-পরবর্তী হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগ বেশি নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। প্রার্থীদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চেষ্টা, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, সমর্থকদের মধ্যে বিরোধই এই হামলা-সহিংসতার অন্যতম কারণ ছিল। এ পরিস্থিতিতে দেশে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই শুরু হওয়া সংঘাতে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। প্রতীক বরাদ্দের পর এর মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচন ঘিরে ১৮ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ দিনে হামলা, সংঘর্ষ, নাশকতা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২১৫ জনকে। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি। তাদের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ঝিনাইদহের পোড়াহাটিতে অন্তত ৪০টি, মাদারীপুরের কালকিনিতে ৪৫টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টির বেশি দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে পিরোজপুরের ইন্দুরকানি, নেত্রকোনার কেন্দুয়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনার ডুমুরিয়া, নাটোর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, ঢাকার ধামরাই, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, খোকসা ও কুমারখালী, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাজশাহীর পবা ও পারিলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা, হামলা, ভাঙচুর নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। যেখানেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, নির্বাচনি এলাকায় ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে পেশিশক্তি প্রদর্শন ও সহিংসতা করার পরিকল্পনা যারা করছে তাদের এরই মধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা হয়েছে। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী হামলা, ভাঙচুর, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।