দেশে এখন একসঙ্গে দুটো সরকার, একাদশ রয়েছে দ্বাদশেরও শপথ হয়েছে
—কর্নেল (অব.) অলি আহমদ
প্রেসিডেন্ট, এলডিপিপ্রতি আসনে দুজন করে সংসদে এখন ৬৪৮ জন শপথবদ্ধ এমপি
—রুহুল কবির রিজভী
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি
সংবিধানে একটি সংসদের কথা আছে দুটির কথা বলা হয়নি
—মতিউর রহমান আকন্দ জামায়াতের প্রচার সম্পাদক ও আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্টবাস্তবে যেসব এলাকায় নতুন এমপি হয়েছেন সেখানে দুজনই আছেন
—মনজিল মোরসেদ
সিনিয়র আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
একাদশ সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই দ্বাদশ সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ নিয়ে রাজনীতিতে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক শিবির থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে— দেশে এখন দুটো সংসদ চলছে। একাদশ সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি। দ্বাদশেরও শপথ হয়েছে। অর্থাৎ সংসদ সদস্য সংখ্যা ৬৪৮। প্রতি আসনে দুজন করে এমপি রয়েছেন। ১৯ দিন মেয়াদ থাকতেই এমপি ও মন্ত্রিদের শপথ গ্রহণ সংবিধান লঙ্ঘন বলেই তাদের অভিযোগ।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সংবিধানের চেতনা হলো একটি এলাকার জন্য সংসদ সদস্য হবেন একজন। বাস্তবে যেসব এলাকায় নতুন এমপি হয়েছেন, সেখানে দুজনই আছেন। একাদশ সংসদের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। সংসদ বাতিলও করা হয়নি। নতুন সংসদ সদস্যদের শপথের আগে রাষ্ট্রপতি একাদশ সংসদ ভেঙে দিলে এমন বিতর্ক তৈরি হতো না। এখন প্রশ্ন উঠলে এর জবাব কী? এই বিতর্কের অবসান করা উচিত ছিল।
জানতে চাইলে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘এখনো একাদশ সংসদ রয়েছে, দ্বাদশ সংসদে যারা রয়েছেন তাদেরও শপথ হয়েছে। দেশে এখন এক সাথে দুটো সরকার চলছে। কারণ এখন পর্যন্ত একাদশ সংসদ বিলুপ্ত করা হয়নি। একাদশ সংসদের মেয়াদ রয়েছে আগামী ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কখনো আইন কিংবা সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। সংবিধান অনুসরণ করে কোন সরকার এলো কোন সরকার গেল এসব নিয়মের তোয়াক্কা তারা করেন না। এগুলো তাদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তাদের উদ্দেশ্যে হচ্ছে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা। জনগণকে অন্যায়ভাবে শাসন করা। দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করা। পুরো জাতি দেখেছে, ভোটকেন্দ্রে ভোটারবিহীন গায়েবি ভোটে তারা কিভাবে সংসদ সদস্য হয়েছেন। আর আগে যারা ছিলেন তাদের সম্পদ কিভাবে, কতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সরকারের কাছে আইনের কথা বলে কোনো লাভ নেই। তারা কোনো আইন মানেন না।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘পেশিশক্তির বলে মানবাধিকার, সংবিধান ও গণতন্ত্রের জীবন্ত পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে— রাষ্ট্রপতি আগে ভেঙে না দিয়ে থাকলে প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ ভেঙে যাবে। যেহেতু রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেননি, তার মানে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত একাদশ সংসদের যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তারা সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে দেশে মিডনাইট একাদশ সংসদের ৩৫০ জন আর ডামি দ্বাদশ সংসদের ২৯৮ জন মোট ৬৪৮ জন শপথবদ্ধ এমপি রয়েছেন। এখন রাষ্ট্রপতি সংসদ ডাকলে দুই সংসদের সদস্যরাই তাতে যোগ দিতে পারেন। অথচ এটি সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। আগামী ২৯ জানুয়ারি একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়া অবধি এই অরাজকতা থাকবে। এটি একটি চরম সাংবিধানিক লঙ্ঘন। গণতন্ত্র ও দেশের স্বার্থে এই সময়ের মধ্যে দ্বাদশ অবৈধ সংসদ বাতিল করে দিতে পারেন উচ্চ আদালত। জনগণের প্রত্যাশা শেষ আশ্রয়স্থল আদালত তাদের যুগান্তকারী ভূমিকা নিতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে দুটি সংসদ বহাল অর্থাৎ প্রতি আসনে এখন দুজন করে এমপি! সত্যিই সেল্যুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ বানিয়েছে সরকার। সংবিধান বিচ্যুত অবৈধ পন্থায় অবৈধ শপথে অবৈধভাবে জন্ম নেয়া অবৈধ সংসদের অবৈধ কার্যক্রম ও অবৈধ মন্ত্রিপরিষদের কোনো অন্যায্য আদেশ-নির্দেশ দেশের জনগণ মানতে বাধ্য নয়। এ কারণেই আওয়ামী লীগের গোটা শাসনামল দুর্নীতি, মহা-হরিলুট, মহা-সম্পদ পাচার ও মহা-মাফিয়া চক্র কবলিত।’
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এই আলোচনাটা দূর করা যেত যদি নতুন সংসদ সদস্যদের শপথের আগে রাষ্ট্রপতি একাদশ সংসদ ভেঙে দিতেন। এটি না করার কারণে একাদশ সংসদ রয়ে গেছে আর দ্বাদশ সংসদ তো আছেই। তাই এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানের চেতনা হলো— একটি এলাকার জন্য সংসদ সদস্য হবেন একজন। বাস্তবে যেসব এলাকায় নতুন এমপি হয়েছেন, সেখানে দুজনই আছেন। একাদশ সংসদের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। সংসদ বাতিলও করা হয়নি। এটি হলো বাস্তবতা।’ তিনি বলেন, ‘শপথের পর অনেক এমপি মন্ত্রীও হয়ে গেলেন। শপথের পরই তো সংসদ সদস্য হয়ে গেলেন। হয়তো প্রথম অধিবেশন শুরু হয়নি। সেটি ভিন্ন জিনিস। কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েই মন্ত্রী বানানো হলো। কেননা, মন্ত্রী হতে হলে সংসদ সদস্য হতে হয় ৯০ শতাংশ। আর ১০ শতাংশ টেকনোক্র্যাট। ১০ শতাংশের বাইরে যারা মন্ত্রী হয়েছেন, তারা সবাই এমপি হিসেবে হয়েছেন। এই জায়গায় প্রশ্ন উঠলে জবাব কী? এই বিতর্কের অবসান করা উচিত।’
জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মতিউর রহমান আকন্দ আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশের সংবিধানে রয়েছে দেশে একটি সংসদ থাকবে। দুটো সংসদের কথা কোথাও বলা হয়নি। একাদশ সংসদের সময় রয়েছে আগামী ২৯ তারিখ পর্যন্ত। কিন্তু এখন দ্বাদশ সংসদের শপথ গ্রহণ করায় দেশে এখন সাংসদ সংখ্যা ৬৪৮ জন। যা আইনগত অসাংবিধানিক।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আইন ও সংবিধান মানে না। রাতের ভোটে যে এমপিরা হয়েছিলেন, তাদের মেয়াদ তো পাঁচ বছর হয়নি। এখন যে আবার ৩০০ এমপি শপথ নিলেন, এর বৈধতা কোথায়? এখন তো ৬০০ এমপি হয়ে গেল। এমপি না হয়ে থাকলে মন্ত্রীদের শপথ কীভাবে পড়ানো হলো?’ সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে— রাষ্ট্রপতি ভেঙে না দিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলে সংসদ ভেঙে যাবে। তাহলে আগের সংসদ তো ভাঙেনি। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়নি। কেননা, একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম বৈঠক হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি।’
জাতীয় সংসদের স্পিকারের উদ্দেশে এই আইনজীবী বলেন, ‘স্পিকার আইনের ছাত্র। সংবিধান সম্পর্কে আপনার ভালো ধারণা থাকার কথা। আমি বিশ্বাস করি, আছে। ৭২(৩) নিয়ে কী করবেন আপনি? ১৯ দিন আগে এমপিদের শপথ পড়ানো হয়েছে। আগের ৩০০ এমপির কী হবে? এদের কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই। ১০ জানুয়ারি এমপিরা শপথ নিয়ে ১১ তারিখ মন্ত্রিসভা হলো। মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ১০ শতাংশ। অনেকেই নতুন এমপি হিসেবে শপথ নিয়ে মন্ত্রী হলেন। মন্ত্রিসভারই তো কোনো বৈধতা নেই। আমি মনে করি, এটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। এখন ৬০০ এমপি। এটি অবৈধ। এর উত্তর চাই। যদি সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি সম্মান থাকে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা ও ৩০০ জন এমপি দ্রুত পদত্যাগ করুন। নতুবা সংবিধান লঙ্ঘন করা হবে। এটি রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। এগুলোর জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।’