দেশজুড়ে নির্বাচনি বিরোধ অব্যাহত

মো. নাঈমুল হক প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৪, ১২:০৫ এএম
দেশজুড়ে নির্বাচনি বিরোধ অব্যাহত

দুই মাসে সহিংসতায় প্রাণহানি ১৫, শতাধিক গুলিবিদ্ধসহ আহত ২২০০

  • নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা
  • ৩৫০টির বেশি গৃহ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর-লুটপাট
  • ভোট প্রদানে বিরত থাকা ব্যক্তিদের বাড়িতেও হামলা
  • কোনো একজন প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেয়াই মূল কারণ

এসব তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যায় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়নি
—নুর খান লিটন
বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী

এখনই দলের হাইকমান্ডকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিরোধ মেটাতে মনোযোগ দিতে হবে 
—অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী
চেয়ারম্যান, শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ, ঢাবি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে গত বছরের ১৫ নভেম্বর। তফসিলের পর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ জেলায় ৩৫০টির বেশি গৃহ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। দুই মাসের এসব সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৫ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ২২০০ জন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ১০০ জনেরও বেশি। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, এসব তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যায় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়নি। নিজ দলের মধ্যে এ রকম সংঘাতের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। 

জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তিন ধরনের সংঘাত হয়েছে। নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তীতে এসব সহিংসতা হয়। এইচআরএসএসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার পর থেকে ৬ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ জেলায় সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে সাতজন এবং ১৬০০ জনের বেশি আহত, ২০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ, ৫০টির বেশি গৃহ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও ৪০টিরও বেশি নির্বাচনি কেন্দ্র ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিনে কমপক্ষে ৫০টি সহিংসতার ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ, বরগুনা এবং কুমিল্লায় নিহত হয়েছেন তিনজন এবং ১৫০ এর অধিক মানুষ আহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনের প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট এবং প্রিসাইডিং অফিসাররাও আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এদিন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৩০ জনের অধিক সাংবাদিক আক্রমণ, লাঞ্ছনা ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাই, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশের অন্তত ৩৯ জেলায় সংঘর্ষ, সংঘাত, হত্যা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে অন্তত পাঁচজন নিহত, ৪৫০ জনের বেশি আহত, ৬০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ, ৩০০টির বেশি গৃহ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। 

যে সব নাগরিক ভোট প্রদান করেননি এমন কিছু মানুষের ওপর ও তাদের বাড়িতে হামলা হয়েছে। পরাজিত কিংবা বিজয়ী দলের প্রার্থী, ভোটার ও কর্মী-সমর্থকসহ সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মাবলম্বী ও বেদে সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহের পোড়াহাটিতে অন্তত ৫০টি, মাদারীপুরের কালকিনি ও কাউয়াকুড়ির ৫০টি, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ৩০টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টির অধিক দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এ সময় শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, গবাদিপশুসহ আসবাবপত্র লুটপাট হয়েছে। 

এছাড়াও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার, মানিকগঞ্জের সিংগাইর ও হরিরামপুর, পিরোজপুরের ইন্দুরকানি, নেত্রকোনার কেন্দুয়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনার ডুমুরিয়া, নাটোর, নোয়াখালী, নেত্রকোনা, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, ঢাকার ধামরাই, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও কুমারখালী, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখান ও গজারিয়া, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাজশাহীর পবা ও পারিলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের ঘটনায় বিভিন্ন দলের সমর্থক, সাধারণ মানুষ বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ অন্তত পাঁচজনের প্রাণহানি, ৪৫০ জনের বেশি আহত, ৬০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ ও কমপক্ষে ৩০০টি বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চলছে হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ অবরুদ্ধকরণ। কোনো একটি নির্দিষ্ট দলকে নির্বাচনে ভোট দেয়া কিংবা না দেয়া এবং কোনো একজন প্রার্থীর পক্ষ নেয়ার প্রতিক্রিয়ায় এই সহিংসতার মূল কারণ। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর ও বেলকুচিতে ঈগল প্রতীকে ভোট দেয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক জেলেপাড়া, ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চড়াও হয়ে সেখানে প্রতিমা ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও গবাদিপশু নিয়ে যায়। 

চাপাইনবাবগঞ্জ-১, তাঁতিপাড়ায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ছয়টি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ৫০টি হিন্দু পরিবারকে গত সাত দিন ধরে অবরুদ্ধ করে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে। ঠাকুরগাঁও-১ আসনে তেনাই তোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে ভোট প্রদান শেষে রোশনি রায় ও জয়দেব বর্মণ নামের দুজনকে হামলা করা হয়। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ঈগল প্রতীকের সমর্থক পিপলু সাহা ও রঞ্জন সাহা নামের দুজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের সমর্থন করায় ১৫ জন সংখ্যালঘুকে মাঝিপাড়ায় তাদের বাড়িঘরে হামলা করে আহত করা হয়। গাইবান্ধা-৫ আসনে চারটি হিন্দু বাড়িতে হামলা করে প্রায় পাঁচ লাখ নগদ টাকা ও গবাদিপশু কেড়ে নেয়া হয়। এছাড়াও মাদারীপুরের কালকিনিতে বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যরা ও ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরা। 

এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও শঙ্কা প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)। ১৭ জানুয়ারির প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংগঠনটির নির্বাহী ইজাজুল ইসলাম বলেন, সরকার ও সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচনি সহিংসতার সব ঘটনা আমলে নিয়ে দ্রুততার সাথে নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সমুন্নত রাখতে হবে।
এ সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা জানিয়ে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী, আইন ও সাালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী নুর খান লিটন আমার সংবাদকে বলেন, মানবাধিকার সংগঠনের এসব তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যায় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়নি। নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, হামলা ও সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ঘরেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এক তরফা নির্বাচন করেও সহিংসতা বন্ধ হয়নি। নিজ দলের দুই গ্রুপের মধ্যে যে সংঘাত তৈরি হয়েছে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও নির্বাচনে উৎসাহিত করে। কেন্দ্রে বা শহরগুলোতে সরকারের এ উদ্দেশ্য বাস্তাবায়িত হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস্তবায়িত হয়নি। সেখানে দলের উদ্দেশ্যের চাইতে ব্যক্তির প্রভাব খাটানোর ইচ্ছে বেশি ছিল। ফলে দুটো গ্রুপের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতেও এর প্রভাব রয়েছে। বিরোধীরা এর সুফল ভোগ করবে। সেজন্য এমন সিদ্ধান্ত না নিতে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলাম। এখন দলের হাইকমান্ডকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দলীয় বিরোধ মেটাতে মনোযোগ দিতে হবে। অন্যথায়, এ বিভক্তি ও সংঘাত চলতেই থাকবে।