- স্থায়ী পুনর্বাসন চায় বস্তিবাসী
- বস্তি বা টিনশেড ঘর নির্মাণ করা যাবে না
- তীব্র শীতে মানবেতর জীবনযাপন
- ক্ষতিগ্রস্তরা আর্থিক সহায়তা পাননি
- ২০০টি ঘর পুড়ে যায়
ডিএনসিসির মেয়র বলেছেন এখানে কোনো টিনশেড ঘর উঠবে না
—মোল্লা আব্দুল ওয়াদুদ
স্বত্বাধিকারী, মোল্লাবাড়ি বস্তি
বস্তিটি যেহেতু মালিকানাধীন, তাই তিনি ঘর নির্মাণ করতে পারবেন
—হুমায়ুন কবির খান
বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা, ডিএনসিসি
পুড়ে যাওয়া কারওয়ান বাজার এফডিসির পাশে মোল্লাবাড়ি বস্তির জায়গায় কোনো ধরনের বস্তি বা টিনশেড ঘর নির্মাণ করতে দেয়া হবে না। যদি করতে হয় তাহলে ভবন নির্মাণ করতে হবে। এতে করে ৩০০ পরিবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও প্রশাসন থেকে এসব বলেছে বলে অভিযোগ করেন মোল্লাবাড়ি বস্তির স্বত্বাধিকারী মোল্লা আব্দুল ওয়াদুদ। তার সাথে কথা হলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, বস্তি পুড়ার পর ডিএনসিসির মেয়র আতিকুর ইসলাম এসে বলেছেন, এখানে কোনো টিনশেড ঘড় উঠবে না। যদি করতে হয় তাহলে বভন নির্মাণ করতে হবে। আমার ইচ্ছা এই গরিব মানুষগুলো এখানে কম টাকায় থাকুক। বর্তমানে ভবন নির্মাণ করার মতো সামর্থ্য নেই। তবে সবার সাথে আলাপ-আলোচনা করে নতুন কিছু করব। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত যারা এখানে ছিল তারাও ক্ষতিগ্রস্ত।
বস্তি সংলগ্ন মসজিদের ইমাম হাফিজুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি আমার সংবাদকে জানান, পরিদর্শনে এসে কমিশনার বলে গেছে বস্তিতে নতুন করে টিনশেড ঘর বানাতে পারবে না। যদি করতে হয় তাহলে পাকা ভবন নির্মাণ করতে হবে। যদি এমনটিই হয় তাহলে ৩০০ পরিবার কোথায় যাবে। স্থায়ী কোনো পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে তাদের তাড়ানো ঠিক হবে না। তিনি আরও জানান, এই বস্তির মালিক মোল্লা আব্দুল ওয়াদুদসহ সাত ভাই ও চার বোনের পৈতৃক সম্পত্তি। দীর্ঘ দিন ধরেই এখানে বাঁশের খুঁটির ঘর ভাড়া দিয়ে আসছেন তারা।
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইলিয়াস নামের এক বস্তির বাসিন্দা আমার সংবাদকে জানান, আমাদের সব কিছু শেষ কিছুই নেই শুধু একটি প্যান্ট পরে বের হইছি। বউ বাচ্চা ভাই-বোন নিয়ে কেমনে বাঁচব জানি না। যদি বহুতল ভবন হয় তাহলে বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে বাইরে থাকা প্রায় অসম্ভব। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে আগুন লাগাটা তাড়ানোর জন্য কারো চক্রান্ত হতে পারে। কারণ আমরা জানতে পেরেছি, এখানে কারওয়ান বাজারের মাছের মার্কেট বানানোর পরিকল্পনা করছে তারা।
বস্তিবাসীদের অভিযোগ, এখনো সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিকল্প আবাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। উল্টো পুলিশ দিয়ে জায়গা খালি করতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বস্তিবাসীর। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা যেন পোড়া বস্তির জায়গা ছেড়ে দেন। এখানে প্রশাসন মাটি ভরাট করবে। তবে অস্থায়ী আবাসের ব্যবস্থা না করে বস্তি ছাড়তে নারাজ এখানকার বাসিন্দারা। আগে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি তাদের। বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন সম্পর্কে কেউ কিছুই বলেনি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে নিঃস্ব মানুষ বস্তির সামনের রেললাইনের দুই পাশে খোলা স্থানে অস্থায়ী ছাউনি ও চৌকি ফেলে অবস্থান করছেন। পুরুষরা কাজে চলে গেলেও বস্তির নারী, শিশু ও বয়স্করা এসব স্থানে বসে আছেন। তাদের চোখে-মুখে হতাশা ও অনিশ্চয়তা। এরই মধ্যে পোড়া বস্তি এলাকায় পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। স্থানীয়দের মধ্যে যারা পোড়া ঘরের স্থানে চৌকি পেতে অবস্থান করছেন তাদের স্থানটি ছেড়ে চলে যেতে বলছে পুলিশ। তা ছাড়া পুড়ে যাওয়া বস্তির লোকজন রেললাইনের পাশে ও অন্যান্য বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভালো আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। সব কিছু হারিয়ে তীব্র শীতে অন্যের দেয়া একটি পাতলা কম্বলে পার করছে দিন-রাত। আগামী দিনটি কিভাবে কাটাবে তার কিছুই জানেন না তারা। শুরুতে কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন সাহায্যে এগিয়ে এলেও যত দিন যাচ্ছে ততই কষ্টের দিন আসছে। কারণ তাদের অর্থ ও সম্পদ যা ছিল তার সবই আগুনে শেষ হয়ে গেছে।
নিজেদের পুনর্বাসন ও সাহায্যের কথা জানতে চাইলে আ. মালেক নামে একজন বলেন, আগুনে দগ্ধ হয়ে আমার ছেলের বউ ও নাতি হাসপাতালে ভর্তি আছে। তাদের ভালো চিকিৎসা করাব সেই অবস্থাও নেই। কারণ আমার যা ছিল তার সবই আগুনে পুড়ে গেছে। গায়ে দেয়া এই গেঞ্জি আর লুঙ্গিটা পরে বের হয়েছি। কারো কাছ থেকে তেমন কোনো অনুদানও পাইনি। সরকার যদি আমাদের জন্য স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করত তাহলে দুঃখ গুছে যেত। যদিও ডিএনসিসি থেকে প্রতিটি পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউই সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা। তা ছাড়া মালিকপক্ষ থেকেও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করেনি বলেও জানান তারা। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীরা স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য সরকারের সাহায্য কামনা করছেন। এর আগে গত ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাতে বস্তিটিতে আগুন লাগে। প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুজন নিহত ও দুজন দগ্ধ হয়েছেন।
বস্তির মালিক এই কথা বলেও সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, মেয়র আতিকুল ইসলাম এমন কোনো কথা বলেননি। কারণ এর কোনো লিখিত প্রামাণ নেই কারো কাছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানি না। তবে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম এমন কোনো কথা বলেছেন বলে জানা নেই।’
পুনর্বাসন ও সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খান আমার সংবাদকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারছি না। মোল্লাবাড়ি বস্তিটি যেহেতু মালিকানাধীন তাই সে তার মতো করে ঘর নির্মাণ করতে পারবে। তবে মেয়র সাহেব এ ধরনের কথা বলেছেন কি-না তা আমার জানা নেই। প্রতিটি পরিবারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা করার কথা দিয়েছেন তা প্রক্রিয়াধীন।’