- অভিযানের প্রভাব নেই বাজারে
- ১০ টাকা বেড়ে কমেছে দুই টাকা
- আরও সময় চায় খাদ্য মন্ত্রণালয়
দাম কমতে আরও দু-তিনদিন সময় লাগবে
—জয়নাল আবদিন
আভিযানিক দলের সদস্য, খাদ্য মন্ত্রণালয়
ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই
—সাধন চন্দ্র মজুমদার, খাদ্যমন্ত্রী
নতুন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে রদবদলের সুযোগে বাজারে উত্তাপ ছড়িয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট। অথচ পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। পবিত্র মাহে রমজানকে সামনে রেখে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। রম্য গল্পের আদলে ১০ টাকা বাড়িয়ে দুই টাকা কমানোর মডেল বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে বরাবরের মতো লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে চুনোপুঁটি ধরতে ব্যস্ত প্রশাসন। রাঘববোয়ালদের ডেরায় হানা দিচ্ছে না আভিযানিক দল। টিভি-ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে খুচরা বাজারে খবরদারি করছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তাই এর কোনো প্রভাব পড়ছে না বাজারে। ভরা মৌসুমে হঠাৎ অহেতুক বৃদ্ধি পাওয়া চালের দাম এখনো কমেনি। কোথাও সামান্য কমেছে, যা বৃদ্ধি পাওয়া দামের তুলনায় অনেক নগণ্য।
মন্ত্রণালয় সূত্রের তথ্যমতে, এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামেও চালের মজুত পর্যাপ্ত। বাজারেও পণ্যটির কোনো ঘাটতি নেই। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ১৬ লাখ ৫৮ হাজার ৬২৪ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৮ টন, গম দুই লাখ ২২ হাজার ৪৪ টন ও ধান ১৬ হাজার ৯০০ টন। এ পরিমাণ খাদ্যশস্যের মজুতকে পর্যাপ্ত বলছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এরপরও ভরা মৌসুমে মিল মালিকদের কারসাজিতে অস্থির চালের বাজার। দুই সপ্তাহ ধরে মিল পর্যায় থেকে বস্তাপ্রতি ২৫০-৩০০ টাকা দাম বাড়িয়ে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশের পাইকারি বাজারে হু হু করে বেড়েছে দাম। প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। পরিস্থিতি এমন- গরিবের মোটা চাল কিনতে কেজিপ্রতি ৫৬ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকায়। ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণে খোদ খাদ্যমন্ত্রী কঠোর নির্দেশ দিলেও বাজারে এক প্রকার দায়সারা তদারকি করছে কর্তৃপক্ষ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি কার্যক্রম চলছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। তাছাড়া দাম যাচাইয়ের চেয়ে দোকানের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা এসব নিয়ে মনোযোগী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। অসাধু মিলারদের না ধরে পাইকারি ও খুচরা বাজারে ঘুরে সময় নষ্টের পাশাপাশি লোকদেখানো শুটিংয়ের মাধ্যমে চলছে বাজার তদারকি। গত শুক্র ও শনিবার রাজধানীর বাজার ঘুরে ট্রেড লাইসেন্স না থাকা, বেশি দামে চাল বিক্রি ও মূল্যতালিকা না থাকাসহ সুনির্দিষ্ট নানা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও দৃশ্যমান কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, দায়সারাভাবে চলছে অভিযান। নাম প্রকাশ না করে রাজধানীর বাড্ডা বাজারের একজন ব্যবসায়ী আমার সংবাদকে বলেন, ‘বাজারে তদারকি টিম আসবে এটা আগে থেকেই সবাই জানত। তাছাড়া পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের ধরে কোনো লাভ নেই। কারণ মিলে দাম বাড়লে খুচরায় বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। প্রশাসনের উচিত মিলার সিন্ডিকেট ধরা।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘যে রোগের সে ওষুধ না দিলে রোগ সারবে না। আগে থেকে জানিয়ে, ক্যামেরা নিয়ে বাজারে এসে খুব বেশি লাভ হবে না।’
গতকাল শনিবার রাজধানীর বাড্ডা বাজারে তদারকির দায়িত্বে থাকা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জয়নাল আবদিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি তারা বেশি দামে কিনেছেন তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ক্রয়ের রশিদও যাচাই করে দেখেছি। তবে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে আড়তে দাম কমতে শুরু করেছে। পাইকাররা জানিয়েছেন, আজ (গতকাল) যেসব অর্ডার হচ্ছে সেগুলোতে বস্তাপ্রতি ১০০-২০০ টাকা কম দামে কেনা যাচ্ছে। আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে ওই চাল বাজারে আসলে দাম কিছুটা কমবে।’ মূলহোতাদের না ধরে পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেন অভিযান হচ্ছে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘একেবারেই যে ধরা হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। সব ক্ষেত্রেই অভিযান হচ্ছে; অসঙ্গতি থাকলে জরিমানাও করা হচ্ছে।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার নওগাঁয় অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত রাখার অপরাধে ছয় ব্যবসায়ীকে এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মহাদেবপুর উপজেলার তিনটি চালকলের মালিক এবং বদলগাছী ও মান্দা উপজেলার তিন চাল ব্যবসায়ীকে এ জরিমানা করা হয়। এটি নিয়ে তিন দিনে ওই জেলায় ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে এ ধরনের অভিযান খুব একটা কাজে আসেনি। চালের বাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। কোথাও সামান্য কমলেও বর্ধিত দামের তুলনায় তা সামান্য। সারা দেশের বাজারের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত দুই সপ্তাহে কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা দাম বেড়েছে। অভিযান শুরুর পর তা কমেছে দেড় থেকে দুই টাকা। তবে হঠাৎ করে অস্থির হয়ে ওঠা চালের বাজার চারদিনের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরবে বলে জানিয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। গত বুধবার চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে করণীয় ঠিক করতে মিল মালিক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার পর মন্ত্রী সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তবে ইতোমধ্যে তিনদিন পেরিয়ে গেছে। আজ চতুর্থ দিন বাজার আগের অবস্থায় ফেরার কোনো আলামত নেই। মন্ত্রী জানিয়েছেন, আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তাই কঠোরভাবে তদারকির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সে মোতাবেক নির্দেশও দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বড় মিল মালিক ও করপোরেট কোম্পানিকে দায়ী করে আমদানির সুযোগ চেয়েছেন রাজধানীর পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের বক্তব্য শুনে নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, সরকার বড় কোম্পানিগুলোতে সুবিধা দিয়েছিল কম দামে চাল প্রাপ্তির আশায়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি। তারা ‘সত্যিকারের ব্যবসায়িক আচরণ’ না করলে চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। চালের বাজারে অস্থিরতা প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ধানকাটার মৌসুম এলেই সুযোগ সন্ধানী মিলাররা চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ায়। এখন আমন ধানের চাল বাজারে এসেছে, তারপরও দাম কমছে না। তাই মূল্য কারসাজিতে জড়িতদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে।