- রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সরকারের বিশেষ নজর
- বাংলাদেশ সীমান্তে মর্টারশেল আতঙ্ক
- মিয়ানমারের জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়াল জান্তা সরকার
- রাখাইন থেকে সরে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলো
বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ঢাকায় মিয়ানমার দূতাবাসের সঙ্গে নিবিড় ও ত্বরিত যোগাযোগ করছে সরকার
—পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলমান থাকলেও এবারের সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা। বিশেষ করে অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করা শান রাজ্যের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একজোট হয়ে চালানো একের পর এক হামলা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ক্ষমতায় থাকা দেশটির সামরিক বাহিনী। বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ হারানো ও প্রতিবেশী দেশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে আশ্রয় নেয়ার খবর প্রতিদিনই উঠে আসছে গণমাধ্যমে। এই ইস্যুতে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা এবং মিয়ানমারের ছোড়া গোলা-বারুদের আতঙ্কে রয়েছে দেশের সীমান্তবর্তী জনপদের মানুষ। এমন আতঙ্কের মধ্যেই মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল নাইক্ষ্যংছড়ির লোকালয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক কাটছে না। যেকোনো মুহূর্তে ফের গোলাগুলির আশঙ্কা করছেন তারা। স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে থেমে থেমে সংঘাত চলমান। এ সংঘাতে বিভিন্ন সময় নিক্ষিপ্ত গোলা তাদের সীমানা পেরিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী লোকালয়ে এসে পড়ছে। এতে নিত্যদিনের কাজে ও শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা।
সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং নতুন করে দেশটি থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ না ঘটে সে বিষয়ে বিশেষভাবে নজর রাখছে সরকার। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, রাখাইনে চলমান সংঘাত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। মিয়ানমারে আমাদের দুটি কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। দূতাবাস দুটি সার্বিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে মন্ত্রণালয় সরকারের সব কর্তৃপক্ষ এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাসের সঙ্গে নিবিড় ও ত্বরিত যোগাযোগ রক্ষা করছে। এছাড়া আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে গত বুধবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর তীব্র সংঘাত চলার মাঝেই জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও এক দফায় ছয় মাসের জন্য বৃদ্ধি করেছে মিয়ানমারের জান্তা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিনা রক্তপাতে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। ওই সময় গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত দেশটির নেত্রী অং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত ও অবরুদ্ধ করা হয়। ক্ষমতা দখলের পর দ্রুত দেশটিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেয় জান্তা। তবে বুধবার নতুন করে জরুরি অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন আরও পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এক ?বিবৃতিতে জান্তা বাহিনী বলেছে, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ইউ মিন্ত সুয়ে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাস বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন।’
প্রায় তিন বছর আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করে সামরিক জান্তা। কিন্তু সেবার অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন হাজার হাজার মানুষ। তারা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। এ কারণে সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালায় জান্তা বাহিনী। আরাকান আর্মি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘাতের মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বেসরকারি দাতব্য সংস্থা। রাখাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করা বেসরকারি সংস্থার একটি বিশ্বস্ত সূত্র স্থানীয় সংবাদমাধ্যম নারিনজারা নিউজকে জানিয়েছেন, অঞ্চলটিতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য যেসব দাতব্য সংস্থা মানবিক সহায়তা প্রদান করে থাকে তারা সেখানকার চলমান সংঘাত থেকে দ্রুত সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। মংডু ও বুচিডংয়ের বিভিন্ন জায়গা থেকেও এসব সংস্থার কার্যক্রম বন্ধ করার পরিকল্পনাও চলছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।
উল্লেখ্য, গত ২৬ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে টেকনাফের হ্নীলা, মিনাবাজার, খারাংখালী, খারাংগাঘোনা, হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, উখিয়ার পালংখালী, বালুখালী এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, আমতলী ও নয়াপাড়া সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। পরের দিন টেকনাফের উলুবনিয়া এবং পালংখালীর বটতলী এলাকায় গুলি ও মর্টার শেলের টুকরা এসে পড়ায় দুই উপজেলার সীমান্ত এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর একদিন পরে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে আকাশ মহড়া দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকাপ্টার। নিরাপত্তাজনিত কারণে ২৭ জানুয়ারি সীমান্তের পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা একদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।