- ডিভাইস আসক্তির অন্যতম কারণ শহরে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ
—ড. এইচ এম সাইদুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, জবি- ৮০ শতাংশ শিশু ডিভাইস আসক্ত। তাদের অবাস্তব চাহিদা প্রচুর
—মো.ওয়াহিদ আনোয়ার রনো, সিইও, সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর, রিস্টার্ট মেন্টাল হেলথ সার্ভিস
শিশুদের খেলার প্রধান মাধ্যম এখন ট্যাব ও মোবাইল ফোন গেম। বিভিন্ন ডিভাইসের ডিজিটাল গেমে তারা এখন ভয়ঙ্কর আসক্তিতে পড়ছে। কয়েক বছর আগেও খেলা বলতে গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, লাটিম, মার্বেল, ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডু, দৌড় এসব ছিল। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারে সেসব খেলাধুলার এখন শুধুই স্মৃতি। দেখা যায়, বাসা থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট কিংবা পার্কে গিয়েও অনেক শিশু মোবাইল নিয়ে বসে আছে। আশেপাশে কী হচ্ছে— সেটা জানার আগ্রহ নেই তাদের। যে কিশোরটি খেলাধুলা আর বই পড়ায় ব্যস্ত ছিল, বিশেষ করে গল্পের বই পড়ত; মুঠোফোন ব্যবহার শিখে সে এখন ডুবে গেছে নানা ধরনের গেমে। আর বই পড়ে না, মা-বাবার সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না, সারা দিন মুখ গুঁজে থাকে মুঠোফোনে।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্বের মতো অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনই কর্মব্যস্ত। উভয়েই ছুটছেন ক্যারিয়ার ও সফলতার পেছনে। এদিকে সন্তান বড় হচ্ছে প্রায় একা একা। অনেক সময় মায়েরা শিশুকে খাবার খাওয়াতে, কান্না থামাতে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও ভিডিও গেমসের অভ্যাস করাচ্ছেন। কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের এই সহজ সুযোগে এর প্রতি আসক্তি বেড়েই চলছে। গেমসের কারণে মারমুখী ক্ষ্যাপাটে আচরণ, বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, অল্পতেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়া, ইন্টারনেট না থাকলে অথবা মোবাইল বা কম্পিউটারের চার্জ ফুরিয়ে গেলে অস্থির-আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার ঘটনা তো অহরহই ঘটছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
নেশা মানেই শুধু মাদক নয়। কালের পরিক্রমায় প্রযুক্তির কল্যাণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ধ্বংসাত্মক ভিডিও গেমসে বুঁদ হয়ে থাকার ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষ এমন নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে, যা থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন।
বিশ্বব্যাপী গেমসের প্রতি তীব্র নেশা যে পাবজি গেম থেকে শুরু হয়েছে, তা নয়। ইতিপূর্বে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান, মনস্টার হান্টার ওয়ার্ল্ড, ডটা টু, ভাইস সিটি এবং হাঙ্গারসহ নাম না-জানা অসংখ্য গেমে মানুষের ভীষণ আসক্তি ছিল। অতিরিক্ত গেম খেলায় বাবার বকুনি খেয়ে অভিমানী তাইওয়ানি কিশোরের নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, একটানা ২৪ ঘণ্টার লাইভ ভিডিও গেম খেলতে খেলতে ২২ ঘণ্টার মাথায় যুবকের মৃত্যুবরণ, অনলাইন ভিডিও গেমের জন্য টাকা জোগাড় করতে ১৩ বছরের ভিয়েতনামি কিশোরের ৮১ বছরের বৃদ্ধাকে রাস্তায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তার মানিব্যাগ চুরি এবং লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা, চায়না দম্পতির কম্পিউটার গেমের অর্থের জন্য নিজেদের তিন সন্তানকে ৯ হাজার ডলারে বেচে দেয়া— এরূপ হূদয়বিদারক গেম আসক্তির ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর ঘটেছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস-ঘটিত এ আসক্তিকে মনোবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল মাদক’। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভিডিও গেমসের প্রতি তীব্র আসক্তিকে বিশেষ এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ অসুখের নাম দেয়া হয়েছে ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ বা ‘গেমিং রোগ’। সংস্থার খসড়া একটি নথিতে ভিডিও গেমে আসক্তিকে একটি আচরণগত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে। এ আচরণে আসক্তির সব লক্ষণ রয়েছে।
উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন ব্রিটেন, জার্মানি এবং চীনে ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত হবার জন্য আলাদা চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে এ ধরনের আসক্তদের মানসিক রোগীর মতোই চিকিৎসা দেয়া হয়। থেরাপিসহ বিভিন্ন চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক-সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের আসক্ত মানুষের সংখ্যা সব দেশেই বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্যমতে, দেশের ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সি প্রায় ৬০ লাখ শিশু-কিশোর ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির কারণে নানা জটিলতায় ভুগছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শতকরা ৯০ ভাগ পরিবারে এখন শিশুদের খেলনার তালিকায় প্রথমেই রয়েছে মোবাইল ফোন; অবুঝ শিশুদের জন্য খেলনা মোবাইল আর বুঝমান শিশুদের জন্য অ্যানড্রয়েট মোবাইল। শিশুর বায়না পূরণে মোবাইলে গেমস দেখা বা গান শোনা যেন এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে মোবাইল ফোনের বিকিরণের কারণে শিশুর চোখে ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একটি শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম। ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে। বাংলাদেশেও ইন্টারনেট প্রসারের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারী, যাতে রয়েছে শিশুরাও। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এইচ এম সাইদুর রহমান আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের জীবনে ডিভাইস আসক্তি আধুনিক প্রযুক্তির খুবই ইনফ্লুয়েন্স রয়েছে। এর পরিধি ও তীব্রতা মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে বেশি। শিশুরা খেলাধুলা করতে পারছে না। কারণ শহরে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। অপরদিকে আমাদের জীবনের ব্যস্ততা ও ধৈর্যের সীমা কমে যাওয়ায় শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছে না পরিবার। ফলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার কোয়ালিটি টাইম ব্যয় করা খুবই জরুরি। আমাদের এখনই সচেতন হয়ে সবার মধ্যে সাড়া জাগাতে হবে। ডিভাইসের সঠিক ব্যাবহার করার কথাও মাথায় রাখতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রিস্টার্ট মেন্টাল হেলথ সার্ভিসের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর-সিইও মো. ওয়াহিদ আনোয়ার রনো আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে বলেন, যেসব বাচ্চা ডেভেলপমেন্টাল, মেন্টাল ডিজঅর্ডার, অটিজম, বিহেবিয়ার থেরাপিসহ নানা সমস্যা নিয়ে আসে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ডিভাইসে আসক্ত। তাদের বয়স সাধারণত চার থেকে শুরু। এরা অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে চায় না; খাবারে থাকে অরুচি। একা একা সময় কাটাতে পছন্দ করে; একইসঙ্গে ডিভাইসকেন্দ্রিক জগৎ তৈরি হয় তাদের। দেখা যায় খুব অল্প বয়সেই তারা পর্নোগ্রাফিতেও আসক্ত হয়ে পড়ে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে ৮০ শতাংশ শিশু ডিভাইস আসক্ত এবং তাদের অবাস্তব চাহিদাও প্রচুর।