- দশম শ্রেণিতে পড়াকালে মুশতাকের কুনজরে পড়ে তিশা
- ফাঁদে ফেলে তিশাকে
- কাবিননামায় স্বাক্ষর করানো হয়েছে
- এ ধরনের ঘটনা মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নামান্তর
—অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক চেয়ারম্যান, অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
- ফাঁদে ফেলে অল্প বয়সি নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে করার প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন
—ড. তৌহিদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ
সময়ের আলোচিত-সমালোচিত দম্পতি খন্দকার মুশতাক ও তিশা। অমর একুশে বইমেলায় এই দম্পতির দুটি বই প্রকাশ পেলে আলোচনা-সমালোচনা আরও বেড়ে যায়। যদিও তিশার পরিবার এ বিষয়ে শুরু থেকেই চুপচাপ। তবে এবার মুখ খুলেছেন তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম। জানালেন আলোচিত খন্দকার মোশতাকের ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য। তাদের এই অসম বিয়ে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা বিভিন্ন মহলে। তবে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনা ওই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই ঘটনা এত বেশি আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে ফলে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমর্যাদা মারাত্মক প্রশ্নের মুখে পড়েছে। পাশাপাশি অভিভাবকদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছেন টেনশনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অসম বিয়ের ফলে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। কোমলমতি কিশোরীরা পাতানো ফাঁদে পড়ে হতে পারে লক্ষ্যভ্রষ্ট।
যিনি বিয়ে করেছেন তার নাম খন্দকার মুশতাক আহমেদ ওরফে কিং মুশতাক ওরফে মহারাজা মুশতাক। যে শিক্ষার্থীকে তিনি বিয়ে করেছেন তার নাম সিনথিয়া ইসলাম (তিশা)। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাকে ‘রানি’ বলে সম্বোধন করেন মুশতাক।
বয়সের বিস্তর ফারাকে বিয়ে এবং এ নিয়ে ডিজিটাল মিডিয়ায় মাতামাতি সমাজের জন্য কখনো ইতিবাচক হতে পারে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একুশে বইমেলায় মুশতাক-তিশার প্রকাশ্যে ‘তিশার ভালোবাসা’ বই বিক্রি হওয়ায় সামাজিক অবক্ষয় ঘটবে বলে আশঙ্কা করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে অল্প বয়সের ছেলে-মেয়েরা না বুঝে বিভ্রান্ত হবে। অভিভাবকদের কথা অমান্য করে তারা অসম প্রেম-ভালোবাসা এমনকি বিয়ের দিকে ঝুঁকতে পারে।
এদিকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলায় স্ত্রীকে নিয়ে নিজের লেখা বইয়ের প্রচারণায় যান মুশতাক। একপর্যায়ে পাঠক, ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন এই দম্পতি। দুয়োধ্বনি দিয়ে তাদের বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। তাদের উদ্দেশে ‘ভুয়া ভুয়া’ ও ‘ছি ছি ছি ছি’ দুয়োধ্বনি দেন দর্শনার্থীরা। ষাটোর্ধ মুশতাকের সঙ্গে কলেজছাত্রীর বিয়ে মেনে নিতে পারেনি মেয়েটির পরিবার। তাদের অভিযোগ, মেয়েকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছেন মুশতাক আহমেদ। অসমবয়সি দুজনের এই প্রেম ও বিয়ের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। উচ্চ আদালত এ মামলা-সংক্রান্ত শুনানিতে মুশতাককে বলেছেন, নৈতিকভাবে কাজটি তিনি ঠিক করেননি। সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য।
তিশা-মুশতাকের এই সম্পর্ককে ‘বিয়ে’ বলতে নারাজ তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এটাকে আমি বিয়ে বলি না। এটাকে বিয়ে বললে ভুল হবে। তিশাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। অশ্লীল ভিডিওর মাধ্যমে জিম্মি করে তাকে বাধ্য করে কাবিননামায় স্বাক্ষর করানো হয়েছে। আমার মেয়ে তিশা মেডিকেল বোর্ডের সামনে জবানবন্দি দিয়েছে। সে বলেছে যে, তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। অশ্লীল ছবি ও ভিডিও করে তাকে কাবিননামায় স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছে। সে রাজি না হলে তাকে বলা হয় এগুলো ফেসবুকে ছেড়ে দেয়া হবে, টিসি দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হবে। সে (মুশতাক) কাবিননামায় স্বাক্ষর নিয়ে এখন এটাকে বিয়ে হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে।’
দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালে তিশা মুশতাকের কুনজরে পড়ে জানিয়ে ক্ষুব্ধ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মেয়ে যখন আইডিয়াল স্কুলের মুগ্ধা শাখার দশম শ্রেণির ছাত্রী, তখন বিতর্ক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে তার কুনজরে পড়ে। তখন থেকেই সে (মুশতাক) তাকে ফোন দিয়ে ছক আঁকতে শুরু করে কীভাবে তিশাকে আয়ত্তে নেয়া যায়। আয়ত্তের অংশ হিসেবে তার মেয়েকে আনে আমার মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। মুশতাকের মেয়ের নাম তন্বিমা। তন্বিমার সঙ্গে আমার মেয়ের বন্ধুত্ব করায়। তারপর মেয়ের বান্ধবীর পেছনে টাকা খরচ করতে থাকে।’
তিশাকে কাছে পেতে মুশতাকের নানা অপকৌশল তুলে ধরে তিশার বাবা জানান, ‘মুশতাক একদিন এক ছেলেকে ভাড়া করে। ভাড়া করা ওই ছেলেকে আমার মেয়ের বয়ফ্রেন্ড বানায়। এরপর ওই ছেলেকে দিয়েই ছবি তোলায় মুশতাক। এভাবে অন্তত ১০-১২ জনের সঙ্গে আমার মেয়ের অশ্লীল ছবি তুলে সে। তারপর ওই ছবিগুলো দিয়েই তাকে ব্ল্যাকমেইল করে। বিয়ের কাবিননামায় সাক্ষীর স্বাক্ষর দিয়েছে মুশতাকের বাসার কাজের লোক।’
‘মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের রুমের মধ্যেই তিশাকে কোলে নিয়ে নাচে মুশতাক’ এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম। কলেজ অধ্যক্ষের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই দায়ভার কলেজের প্রিন্সিপালও এড়াতে পারবে না। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে এসব কাজ হয়। মুশতাক প্রিন্সিপালের ভালো বন্ধু। তাই প্রিন্সিপাল থেকে সে সহযোগিতা নেয়। তখন প্রিন্সিপাল আমার মেয়েকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে যায় তার রুমে। এভাবেই আমার মেয়েকে তারা ফাঁসায়।’
তিশার বাবা সাইফুল ইসলামের সাথে কথা হয় আমার সংবাদের এই প্রতিবেদকের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আমি মিডিয়ার সামনে মুশতাকের অপকর্ম তুলে ধরার পর থেকে হুমকির মধ্যে আছি। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
গত রোববার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তিশার বাবা মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে যান। পরে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন তিনি। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) বরাবর লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, গত ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি মোবাইল নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে আমাকে বলেন, ‘আপনি বেশি বাড়াবাড়ি কইরেন না, বেশি বাড়াবাড়ি করলে আপনার মেয়েকে মেরে ফেলব।’ বিষয়টি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করেন তিনি।
এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি মুশতাক-তিশা দম্পতিকে সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম থেকে ভিডিও সরিয়ে নিতে লিগ্যাল নোটিস পাঠানো হয়েছে। নোটিসে বলা হয়, এই দম্পতির এমন নোংরা, অসামাজিক, দৃষ্টিকটু ও শ্রুতিকটু যৌন উত্তেজনাকর ভিডিও ও সাক্ষাৎকার পাবলিক প্ল্যাটফর্মে প্রচারের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে অসামাজিক, নোংরা ও যৌন উত্তেজক কর্মকাণ্ডে প্রলুব্ধ করছে, যা এ দেশের ফৌজদারি আইনে অপরাধ। মুশতাক-তিশার এ ধরনের ভিডিও ও সাক্ষাৎকারগুলো সমাজের জন্য কোনো উপকার বয়ে না আনে না বরং সমাজ ও দেশের মানুষকে, তথা তরুণ প্রজন্মকে কু-পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ও যাবে বলেও নোটিসে উল্লেখ করা হয়। নোটিস পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তুলে নিতে কিংবা ডিলিট করে নিতে বলা হয়েছে লিগ্যাল নোটিসে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে এসব বেহায়াপনা ও নোংরা বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো ভিডিও তৈরি থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক দৈনিক আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নামান্তর। আমরা যে বিষয়গুলো থেকে শিখি সে স্থানগুলো সব সময় অবক্ষয়মুক্ত থাকা জরুরি। এ ধরনের অসামাজিক বিষয়গুলো সামনে আসলে কিছু লোক তাদের পুঁজি করে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাদের জন্য পরবর্তী প্রজন্ম এ ধরনের অপরাধ বা অসামাজিক মূল্যবোধ পরিপন্থির দিকে ঝুঁকে। এর মাধ্যমে তাদের মাঝে বিকৃত রুচির জন্ম হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আমার সংবাদের এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বর্তমানে তরুণদের মধ্যে সুগার ড্যাডি বিষয়ে নানা ধরনের মন্তব্য লক্ষণীয়। বিভিন্ন জন নানাভাবে অধিক বয়স্ক পুরুষের সাথে অল্প বয়স্ক নারীর বিয়ে নিয়ে নানা ধরনের হাস্য রসাত্মক মন্তব্য করছে। যা সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় প্রকাশ করে। আইনগতভাবে সুগার ড্যাডিদের এ ধরনের কার্যক্রমের বিরোধিতা করা যাচ্ছে না ঠিকই, তবে এ ধরনের কার্মকাণ্ড সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমাজের মধ্যে নৈতিক ও সম্পর্কগত অধঃপতন ডেকে আনবে। অর্থ, ক্ষমতা কিংবা আভিজাত্য দিয়ে ফাঁদে ফেলে অল্প বয়স্ক নারীদের আকৃষ্ট করে জোরপূর্বক বিয়ে করার প্রবণতা বন্ধ করা খুবই প্রয়োজন।’