সুন্নতে খতনা নিয়েই যখন শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে, ঠিক তখনই নড়েচড়ে বসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযান আর তদন্তে উঠে আসছে— শুধু ট্রেড লাইসেন্সের আড়ালেই চলছে দেশের কথিত স্পেশালাইজড অনেক হাসপাতাল। এমনও ঘটনা দেখা গেছে, এক লাইসেন্স দিয়ে একাধিক হাসপাতাল পরিচালনা করা হচ্ছে কোথাও কোথাও। শয্যা অনুযায়ীও সেসব হাসপাতালে রয়েছে চিকিৎসক সংকট। নামমাত্র চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কথিত সেসব হাসপাতাল। সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রোগী ছেড়ে না দেয়ার প্রবণতায় ভুল চিকিৎসা পদ্ধতির আশ্রয়ও নিচ্ছে হাসপাতালগুলো। এতেই ঘটছে বিপত্তি।
সম্প্রতি এমন ভুল চিকিৎসায় শিশু মৃত্যুর ঘটনার সূত্রপাত ও আলোচনার জন্ম দেয় বাড্ডার ইউনাইটেড হাসপাতাল। নামকরা হাসপাতাল হলেও যাদের ছিল না বৈধ লাইসেন্স। এরপরই মূলত সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে শিশু মৃত্যু ও ভুল চিকিৎসার একাধিক ঘটনা ঘটে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে। সুন্নতে খতনা যখন দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও ধারাবাহিক অভিযান এবং তদন্ত পরিচালনা করছে কথিত হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার অভিযান পরিচালনা করা হয় উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরের হাই-কেয়ার কার্ডিয়াক অ্যান্ড নিউরো স্পেশালাইজড হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে দেখা গেছে, শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই চলছে বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি। সেখানে ২৫ জন রোগীও চিকিৎসাধীন।
অভিযান শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমুহ) ডা. এহসানুল হক বলেন, হাসপাতালটি গত দুই বছর ধরে চলছে। কিন্তু হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য যে লাইসেন্স থাকার দরকার ছিল, তা তাদের নেই। সে জন্য হাসপাতালটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তিনি জানান, হাসপাতালটি ১০০ শয্যার, সে হিসেবে কমপক্ষে ১০ জন চিকিৎসক থাকা দরকার সেখানে। কিন্তু অভিযানের সময় সেখানে চিকিৎসক ছিলেন মাত্র ছয়জন। হাসপাতালটি চলছিল তাদের অন্য আরেকটি হাসপাতাল হাই-কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের লাইসেন্স দিয়ে। হাসপাতালটির ওই শাখায়ও অভিযান চালিয়ে পাওয়া গেছে নানা অনিয়ম। লাইসেন্সের কাগজপত্র ঠিক থাকলেও জেনারেল হাসপাতালের পরীক্ষার ল্যাব পাওয়া গেছে নোঙরা অবস্থায়। নিয়ম অনুযায়ী সংরক্ষণ করা হয়নি বিভিন্ন পরীক্ষার নমুনা। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে এ নিয়ে সতর্ক করে অধিদপ্তর।
এদিকে লাইসেন্স ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনার দায়ে গতকাল বুধবার রাজধানীর আসাদগেট এলাকার কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারও বন্ধ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রাজধানীতে দ্বিতীয় দিনের মতো অবৈধ ক্লিনিক হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের বিরুদ্ধে চালানো অভিযানে হাসপাতালগুলোতে নানা অনিয়মের চিত্র পায় অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনাকারী দল। এর আগে চলমান অভিযানের প্রথম দিনে ১২টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে রেডিয়াম ব্লাড ব্যাংক ও রাজধানী ব্লাড ব্যাংক, টিজি হাসপাতাল, ইসিবি চত্বরে আল হাকিম চক্ষু হসপিটাল, কালশীতে এশিয়ান ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও এইচএস ডায়ালাইসিস অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
প্রসঙ্গত, বাড্ডায় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনার পর এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আয়ান নামে পাঁচ বছরের এক শিশুর মৃত্যু ঘটে। ঘটনার পর হাসপাতালটিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে দেখা যায়, লাইসেন্স ছাড়াই চলছিল হাসপাতালটি। যে কারণে হাসপাতালটির সার্বিক কার্যক্রমই বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়াও দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রবেশ পথে লাইসেন্স ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। তথ্য কর্মকর্তা নিয়োগ ও লেবার রুম প্রটোকল বাধ্যবাধকতাসহ ১০ দফা নতুন নির্দেশনাও দেয় অধিদপ্তর। একই সঙ্গে এসব নির্দেশনা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে বলেও জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
এদিকে অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকবেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী। তিনি জানান, এক মাসের অভিযানে প্রায় এক হাজার ২২৭টি অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হয়েছে। এই অভিযান এখনো চলছে। কোনোভাবেই অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের কার্যক্রম চলতে দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।